images

জাতীয়

ঢাকার নতুন ইমারত বিধিমালা, ক্ষতির মুখে আবাসন খাত

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন

২৪ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৪৭ এএম

বিধিমালা ও ড্যাপে ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিও’ বা ভবনের আয়তন ও উচ্চতা নির্ধারণের সূচক (এফএআর) অনুযায়ী বর্তমানে পাঁচ কাঠার জমিতে পাঁচতলা নকশার অনুমোদন মিলে। কিছুদিন আগেও সমপরিমাণ জমিতে পাওয়া যেত ৯-দশতলা নকশার অনুমোদন। এই পরিমাণ জামিতে ১১০০ থেকে ১২০০ বর্গফুটের ১৬টি ফ্ল্যাট পাওয়া গেলেও, এখন পাওয়া যাবে আটটি ফ্ল্যাট। যার আয়তন হবে প্রতিটির হাজার বর্গফুটেরও অনেক কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে খাদের কিনায় দাঁড়িয়ে আছে আবাসন খাত।

ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) তথা মহাপরিকল্পনা এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা দুই আইনের মাধ্যমে পরিচালিত করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ১৯৫৩ সালের ‘টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্টে’র আওতায় এই মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। অন্যদিকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালাটি হয়েছে ১৯৫২ সালের ‘বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী। রাউজক থেকে পাওয়া তথ্যমতে— নতুন ড্যাপের মাধ্যমেই রাজউক এলাকার ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হবে। একই সঙ্গে কম সময়ের মধ্যে বর্তমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা (২০০৮ সালের) সংশোধন করে নতুন ড্যাপের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হবে।

বর্তমানে রাজউক এলাকার ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিতে হয় ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র এবং নির্মাণ অনুমোদন। ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়া হয় ড্যাপ অনুসরণ করে। অন্যদিকে নির্মাণ অনুমোদন দেওয়া হয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে। এক্ষেত্রে স্বল্প প্রশস্ত রাস্তার পাশের জমির মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলেছেন— ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) অনুসারে অনুমোদন দিলে ফ্ল্যাটের দাম হবে আকাশ সমান, তেমনি জমির দামও কমে যাবে।

এ নিয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) বলছে— ড্যাপ আবাসন শিল্প ধ্বংসের অশনি সংকেত। ড্যাপ (ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান) বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর ভবনের আয়তন বর্তমানের চেয়ে ন্যূনতম ৩৩-৫৩ শতাংশ কমে যাবে। এতে ফ্ল্যাটের দাম কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বাড়বে। এ অবস্থায় আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। এ অবস্থায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে আবাসন কোম্পানিগুলো করছেন না নকশার আবেদন।

রাউজক বলছে, অপরিকল্পিতভাবে নগরীকে ঝঞ্জালে পরিণত করা কাররোই চাওয়া নয়। ছোট ছোট রাস্তার পাশে এভাবে একের পর এক বহুতল ভবন উঠতে থাকলে এই শহরকে আর শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যাবে না। সরু রাস্তা সরুই থাকবে। কোনো দিন প্রশস্ত হবে না। তবে নতুন ড্যাপে অপরিকল্পিত এলাকা যেমন পীরেরবাগ, কাফরুল ও পুরান ঢাকার মতো কিছু এলাকার জমির মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শহরকে বাসযোগ্য রাখতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া যাবে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বলছেন, নতুন ড্যাপে রাস্তার প্রশস্ততা অনুযায়ী ৯টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। আর ইমারতের শ্রেণি করা হয়েছে তিনটি। সম্পূর্ণ আবাসিক, আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ও সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক। এগুলোর প্রতিটির আবার ছয়টি করে ক্যাটাগরি করা হয়েছে। নতুন নিয়মে ব্যবহারযোগ্য ভূমির পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে অর্ধেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ব্যবহারযোগ্য ফ্লোর স্পেসও অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) জানান, ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় একটি অস্থিতিশীল ও অকার্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। আবাসন কোম্পানির নির্মিতব্য ভবনের জন্য কমন ফ্যাসিলিটি, দাফতরিক ও অন্যান্য প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যয় একই থাকবে। এতে ফ্ল্যাটের মূল্য কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বাড়বে। এতে ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা যৌক্তিকভাবে কমে যাবে। ‘আবাসন’ সমস্যা আরও বাড়বে। ভবনের আয়তন কমে গেলে সিরামিক, স্যানিটারি, টাইলস, ইলেকট্রিক কেবল, রড ও সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ, পাথর, বালি, পেইন্ট ইন্ডাস্ট্রিজসহ ২৬৯টি সংশ্লিষ্ট শিল্প গভীর সংকটে পড়বে। সর্বোপরি আবাসন শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে।

এদিকে ২০ ফুটের কম প্রশস্ত রাস্তার উন্নয়নে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কোনো ধরনের আর্থিক বরাদ্দ দেবে না বলে জানিয়ে মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, যেখানে রাস্তা ২০ ফুটের কম হলে অনুমোদনই পায় না, সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হবে না। যারা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে তারা দখল ছেড়ে পরিষ্কার করে দিলেই কাজ হবে।  

ডিএনসিসি মেয়র বলেন, সম্পত্তি বিভাগের সমন্বয়ে রাস্তার প্রশস্ততা বাড়াতে হবে। রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে তাদের চিঠি দিয়ে জানাতে হবে। নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে কেমন ছিল সেটি ডিএনসিসিকে দিতে হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। অবৈধ দখলের ফলে রাস্তা সরু হয়ে যায়। এতে করে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে উল্লেখ করে ডিএনসিসি মেয়র বলেন, মানুষের যাতায়াতে যতটুকু সম্ভব স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনতে হবে।  

এর আগে রাজধানীতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউক পাশাপাশি সিটি করপোরেশন থেকেও অনুমোদন নেওয়ার দাবি জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। মেয়রের দাবির মুখে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় থেকেও বিষয়টি সম্মতি জানালেও,পরে তা বাতিল করা হয়। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশকে ভবন নির্মাণের বিষয়টি অবহিত করার জন্য বলা হয়।

বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রকল্পের পরিচালক পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ড্যাপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন এবং নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি সকল পেশাজীবী সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। গেজেটভুক্ত ড্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলা সম্ভব বলে আশা করছি।

ডিএইচডি/