তানভীর আহমেদ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:৫৯ এএম
স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অর্থনীতি ও যাতায়াত ব্যবস্থার দ্বার যেমন উন্মোচিত হয়েছে তেমনি আরেকটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের অপেক্ষায় বঙ্গবন্ধু টানেল। এরমধ্যেই টানেলের ৯০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে উদ্বোধনের উদ্দেশ্যে জোর প্রস্তুতি চলছে। এই দশ শতাংশ কাজ শেষ করে নদীর তলদেশ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল অপার বিস্ময়ের ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’র স্বরূপ উন্মোচিত হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধন না হলেও টানেল চালুর প্রস্তুতি হিসেবে কর্ণফুলী টানেলের ভেতরে নির্মাণ সরঞ্জাম বোঝাই ট্রাক, পিকআপ কিংবা প্রকৌশলীদের বহনকারী মাইক্রোবাস চলাচল করছে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে স্বপ্নের এ টানেল গিয়ে মিলেছে দক্ষিণের আনোয়ারা প্রান্তে। দুই টিউব বিশিষ্ট মূল টানেল প্রায় প্রস্তুত হয়ে এসেছে। বর্তমানে অগ্নি নিরাপত্তামূলক ফায়ার প্লেট, লাইটিং এবং ডেকোরেশন প্লেট বসানোর কাজ চলছে। এক টানেল থেকে আরেক টানেলে যাওয়ার প্যাসেজ তৈরির কাজও শেষের দিকে। এর আগে টানেলের সাথে দুই প্রান্তের ৬ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড়ের কাজ শেষ হয়েছে। এখন নির্মিত হচ্ছে আনোয়ারা প্রান্তের ওয়াই জংশন পর্যন্ত ৬ লেন সড়ক।
চীনের সাংহাইয়ের ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ এর আদলে দেশের প্রথম এই টানেল পদ্মা সেতুর পর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হতে চলেছে বেল মনে করেন বিশ্লেষকরা।
দেশের মেগা প্রকল্পগুলোতে একের পর এক সময় এবং ব্যয় বাড়লেও একমাত্র ব্যতিক্রম কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প। এ প্রকল্পের সময় এবং ব্যয় কোনোটাই বাড়েনি। শুরু থেকে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। সময় নির্ধারণ করা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, নির্ধারিত বাজেটে এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এ টানেল নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে চীনের সহায়তা পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ২ শতাংশ হারে এ ঋণ দিয়েছে। চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) এই টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
দুটি টিউব সম্বলিত নদীর তলদেশে এই মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এরমধ্যে টানেল টিউবের দৈর্ঘ ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। টানেলটি দুটি টিউবে চার লেনবিশিষ্ট। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক এবং ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজ রয়েছে।
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের কারণে চট্টগ্রাম মহানগরী অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেও কর্ণফুলীর ওই পাড়ে আনোয়ারা থেকে যায় অবহেলিত। সড়ক যোগাযোগ না থাকায় কর্ণফুলী নদীর ওপাড়ে বন্দর সম্প্রসারিত হয়নি। কর্ণফুলী নদীর দুপাড়ে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন গড়ে তুলতে নেওয়া হয় এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ প্রকল্প।
নদীর দক্ষিণে আনোয়ারায় রয়েছে সিইউএফএল, কাফকো, কোরিয়ান ইপিজেড, প্রস্তাবিত চায়না ইপিজেড, পারকি সমুদ্র সৈকত। কর্ণফুলী পেরিয়ে আনোয়ারা দিয়েই কক্সবাজার, বাঁশখালী ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরে যেতে হয়। মাতারবাড়িকে ঘিরে মেগা প্রকল্প বহর, অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল এবং মীরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের সাথে যোগাযোগের লক্ষ্যেই নেওয়া হয় এ টানেল প্রকল্প।
টানেল নির্মাণের চুক্তি সই হয় ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। এর আগে ২০১৪ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও চীনের সরকারি পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। আর চীন সরকার এ টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে। নকশা ও অন্যান্য কাজ শেষে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে টানেলের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্মাণ কাজের প্রায় পুরোটাই যন্ত্র নির্ভর হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করা যাচ্ছে। এটি চালু হলে বন্দর নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে উন্নয়ন, বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, পর্যটন ও আবাসন খাতে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এ টানেল জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের জটিল কাজ শেষ। এখন কিছু টেকনিক্যাল কাজ চলছে। তাতে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। এর ফলে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে প্রকল্পের কাজ। টানেলের মোট দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এরমধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দুটি টানেলে লেন থাকছে চারটি। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্বপ্রান্তের ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকছে। আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মি. দীর্ঘ ফ্লাইওভার। প্রথম টানেল খননে সময় লেগেছে ১৭ মাস। আর মাত্র ১০ মাসেই নির্মাণ হয়েছে দ্বিতীয় সুড়ঙ্গ। ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় তৈরি করা হয়েছে দুটি টানেল। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার। মহানগরী প্রান্তের পতেঙ্গা নেভাল অ্যাকাডেমির পাশ দিয়ে শুরু হওয়া এ টানেল আনোয়ারা প্রান্তের সিইউএফএল এবং কাফকোর মাঝামাঝি স্থান দিয়ে দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে।
প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চাই। দেশের এই মেগা প্রকল্পটির সফল উন্মোচন করতে তৎপর রয়েছি। পাওয়ার, মনিটরিং সিস্টেম ও টোল প্লাজার কাজসহ অল্প কিছু কাজ চলমান আছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই দুটি টিউব চালু করার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস্ জানান, আগামী ডিসেম্বর মাসে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীতে যানবাহনের চাপ আরও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র টানেলের কথা মাথায় রেখে নগরীর সড়ক নেটওয়ার্কে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে- নির্মাণাধীন এলিভেটড এক্সপ্রেসওয়ের নকশায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এখানে যানবাহন উঠা-নামার জন্য বাড়ানো হচ্ছে ইউলুপ এবং আন্ডারপাস।
টিএ/এএস