images

জাতীয়

তবুও ইসির ভাবনায় ইভিএম!

বোরহান উদ্দিন

২০ আগস্ট ২০২২, ০৮:৫৩ পিএম

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন। সংলাপে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে কী কী করা যায় সেই পরামর্শ চাওয়া হয়েছে দলগুলোর কাছ থেকে। সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলো সুষ্ঠুভাবে ইসিতে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি ইভিএমে ভোট নেওয়ার বিষয়েও ভিন্ন মত দেন। বেশিরভাগ দলই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট না করতে নিজেদের আপত্তির কথা নির্বাচন কমিশনকে জানায়। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ তাদের জোটভুক্ত কয়েকটি দল ইভিএমে ভোটে আপত্তি নেই বলে জানায়। এমন পরিস্থিতিতেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ইভিএমে ভোট করার চিন্তাভাবনা করছে নির্বাচন কমিশন।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরের ইভিএমের সব ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে ইসি মনে করছে ব্যালটের চেয়ে ইভিএমে তুলনামূলক স্বচ্ছ ভোট সম্ভব। যদিও এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি। তবে আসছে বৈঠকে ইভিএম না ব্যালটে ভোট হবে সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে। একইসঙ্গে ইভিএমে ভোটের সিদ্ধান্ত হলে কতগুলো আসনে হবে সে বিষয়ও চূড়ান্ত হতে পারে।

গত জুলাইয়ে দীর্ঘসময় ধরে চলা সংলাপের শেষ দিনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সংকট আছে বলে প্রকাশ্যেই বলেছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে সিইসির বক্তব্য ছিল, ইভিএম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ কিছু সমর্থন পাওয়া গেছে। কিন্তু অধিকাংশ দল ইভিএম বিশ্বাস করছে না। এর ভেতরে কী যেন একটা আছে। তবে ইসির পক্ষ থেকে ইভিএমকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না। কিন্তু অনেককেই আস্থায় আনতে পারছে না নির্বাচন কমিশন।

সেদিন আওয়ামী লীগের সহযোগিতা চেয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, 'ইভিএম নিয়ে সংকট থাকবে। তাই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ইসি অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু ইভিএম নিয়ে পুরোপুরি ঐকমত্য নেই।'

ec-2ওইদিন ইভিএম নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার ভাষ্য ছিল, 'আমরা (আওয়ামী লীগ) ইভিএম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। চেতনায় ধারণ করি। কোনো বিশেষ এলাকা নয়; তিনশ আসনে ইভিএমে ভোট হোক। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ দাবি জানাচ্ছি।'

এদিকে সংলাপে পাওয়া বক্তব্য পর্যালোচনা করে সবার অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। কিন্তু ইভিএম নিয়েই ইসি নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে দাবি রাজনৈতিক দলের নেতাদের।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, ইসি যদি বেশিরভাগ দলের মনোভাবের বাইরে গিয়ে ইভিএমে ভোট করেন তাহলে যে ভোটের জন্য এতকিছু সেটা তো গ্রহণযোগ্য হবে না। তাহলে কী ইসি আবারও সরকারকে সুবিধা দিতে গিয়ে বিতর্কিত নির্বাচন করতে চায়? এমনটা হলে গণতন্ত্র আরও হুমকির মুখে পড়বে।’

ইভিএমে ভোট করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এ নিয়ে কথা বলতে প্রয়োজনে ইসিতে যাওয়ার কথা বললেন এই রাজনীতিক।

এদিকে ইসির এমন ভাবনা নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে ইসি সিদ্ধান্ত নিলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে বেগ পেতে হবে।

ec-3সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, একাধিক নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য শুনেই তো মনে হয়েছে তারা ইভিএমেই ভোট করবে। আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া বাকি। ইভিএম তো জালিয়াতির যন্ত্র, যে কারণেই তো সন্দেহ। কিন্তু তারা বলছে এটা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ যন্ত্র। আবার একজন বলছেন মেশিনে সমস্যা নেই, ভয় ডাকাত নিয়ে।’

সুজন সম্পাদক বলেন, ‘অদৃশ্য কারচুরির মাধ্যমে ইসি তার পছন্দের লোকদের বিজয়ী ঘোষণা করতে ইভিএমে ভোট করার কথা ভাবছে। তবে বেশিরভাগ দলের মনোভাব তাদের বোঝা উচিত।’

ইভিএম নিয়ে ইসির ভাবনা জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিগত দিন থেকে আমাদের সময় পর্যন্ত ইভিএমে যত নির্বাচন হয়েছে তার ফলাফল কেমন ও ভোটারদের উপস্থিতি কেমন ছিল এই সবকিছুই বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি পরবর্তীতে যে কমিশন মিটিং হবে সেই মিটিংয়ে আমরা ইভিএম নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হব। দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে এমন সিদ্ধান্তই আশা করি নেওয়া হবে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের হাতে দেড় লাখের মতো ইভিএম। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এ দিয়ে ভোট করা যাবে এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ একশো আসনে। শেষ পর্যন্ত সব আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে আরও তিন লাখের মতো ইভিএম কিনতে হবে।

নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর বলেও জানান এই কমিশনার। আসহান হাবীব খান মনে করেন, যেহেতু নিজেদের মেয়াদে করা নির্বাচন নিয়ে তেমন বিতর্ক হয়নি, সবার সহযোগিতা পেলে সামনেও ইসি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে।

তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নিবন্ধিত দলগুলোর সংলাপে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ১৯টি দল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমে ভোটের বিপক্ষে মত দিয়েছে।

অন্যদিকে সংলাপে অংশ না নিলেও বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই ইভিএমের বিরোধিতা করে আসছে।

তবে ইভিএমে ভোট করতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে মাত্র তিনটি দল। দল তিনটি হলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি। অন্যরা ইভিএম নিয়ে কমবেশি সংশয়–সন্দেহ, আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাসের কথা বলেছে।

ইসির সঙ্গে সংলাপে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অভিযোগ ছিল হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ইভিএম'র ফলাফল পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু সব পর্যবেক্ষণ শেষে সে অভিযোগও নাকচ করেছে ইসি।

জানা গেছে, শিগগিরই রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের এই মতামত জানিয়ে দেবে ইসি।

ec-4ইসি সূত্র বলছে, ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ইভিএমে ৮৬৫টি নির্বাচন হয়েছে। এরমধ্যে সংসদীয় আসনে ২১টি, সিটি করপোরেশন ১২টি, পৌরসভা ১৮১টি, উপজেলা ২২টি এবং ইউপিতে ৬২৯টি ভোট হয়েছে।

অন্যদিকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের হাতে দেড় লাখের মতো ইভিএম। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এ দিয়ে ভোট করা যাবে এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ একশো আসনে। শেষ পর্যন্ত সব আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে আরও তিন লাখের মতো ইভিএম কিনতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নতুন করে ইভিএম কিনতে হলে বড় অংকের টাকার প্রয়োজন হলেও সেটা সিদ্ধান্ত সরকার নেবে। ইসির এটা নিয়ে চিন্তা করার খুব বেশি কারণ নেই।’

নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, যতগুলো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে তারও একটা অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক দলের পরামর্শ এবং তাদের যে যুক্তি সব কিছু বিবেচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিইউ/এমআর