images

জাতীয়

কারওয়ান বাজার স্থানান্তর প্রক্রিয়া কত দূর

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন

২৬ জুলাই ২০২২, ০১:৪২ পিএম

অপরিকল্পিত নগরায়ন হওয়ায় ঢাকা বসবাসের উপযোগীতা হারাতে বসেছে। নগরীকে বসবাসের উপযোগী এবং নাগরিকদের ভোগান্তি কমাতে যত্রতত্র পার্কিং এবং বাজার সরাতে শুরু করে দায়িত্বপ্রাপ্ত সিটি করপোরেশন। যদিও ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান কারওয়ান বাজার স্থানাস্তর প্রক্রিয়া দুই যুগেরও বেশি সময়ে শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি। ঢাকার জ্যাম জট ছাড়াও জনভোগান্তির অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয় এ খোলা বাজারটিকে।

সিটি করপোরেশন কারওয়ান বাজারের মত নগরীর বুকে জেঁকে থাকা খোলা বাজারগুলো স্থানাস্তরে তোড়জোড় দিলেও ব্যবসায়ীরা নতুন বাজারে যেতে নারাজ। তারা বলছেন, নতুন স্থানে ব্যবসা দাঁড় করানো নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। স্থান-কাল বিবেচনায় প্রয়োজনে বহুতল ভবন করে হলেও বাজার রাখার তাগিদ তাদরে। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন বলছে- অচিরেই স্থানাস্তর হতে হবে নির্ধারিত স্থানে। 

দীর্ঘ সময় ধরে গিঞ্জি পরিবেশে গড়ে ওঠা কারওয়ান বাজার স্থানাস্তরে দায়িত্বপ্রাপ্তদের ধীরগতি, এবং ব্যবসায়ীদেরে সরে না যাওয়ার কারণ খুঁজেছে ঢাকা মেইল। 

নগরবাসী বলছেন, উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে আজও বাজার ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন হয়নি। যা এখন সময়ের দাবি। নগরবিদরা বলছেন, ব্যবসা স্থানান্তরে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গেই আলোচনা করতে হবে। না হলে নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত হবে সবাই। 

dhaka

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ‘ঢাকা শহরের তিনটি পাইকারি কাঁচাবাজার নির্মাণ প্রকল্প’ পাস করে ২০০৬ সালের ৪ অক্টোবর। কৃষিপণ্যের বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি কারওয়ান বাজারের যানজট কমাতে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। মহাখালী, আমিনবাজার ও যাত্রাবাড়ীতে এই তিনটি পাইকারি কাচাবাজার নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। তিন দফা সময় বাড়িয়ে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের জুনে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা। এর পর আবারও মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তাও আলোর মুখ দেখেনি। 

সবশেষ জানা যায়, চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বরের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কারওয়ান বাজার এলাকা সম্পূর্ণ খালি করতে চায়। 

কারওয়ান বাজারে প্রায় ২৪ বিঘা জমির ওপরে ডিএনসিসির মালিকানাধীন তিনটি মার্কেট রয়েছে। কারওয়ান বাজারের দোকানগুলো আমিনবাজার, যাত্রাবাড়ী ও মহাখালী স্থানান্তরের জন্য দীর্ঘদিন ধরে মার্কেট সমিতির নেতাদের সঙ্গে ডিএনসিসির আলাপ-আলোচনা চলছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে, রাজধানীর তিনটি পাইকারি কাঁচা বাজার নির্মাণ প্রকল্পের সারসংক্ষেপ থেকে জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ‘ঢাকা শহরে তিনটি পাইকারি কাঁচাবাজার নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শুরুতে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ২০৬.৪৬ কোটি টাকা ধরা হলেও এখন তা বেড়ে ৩৫০.০০ টাকা ধরা হয়েছে। প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়- কারওয়ান বাজারস্থ দোকানগুসমূহ ঢাকা শহরের আমিনবার, মহাখালী ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় নির্মাণাধীন স্থানান্তর করা হবে।

যেখানে আনুমানিক নির্মিত দোকান মহাখালী ১ হাজার ১৬৫, আমিনবাজার ৬৯৭ এবং যাত্রবাড়ীতে স্থানান্তির হবে ৯১২টি। এছাড়াও কারওয়ান বাজার থেকে স্থানান্তরযোগ্য দোকান মোট ১ হাজার ৮০৮টি। যেখানে মাহখালী ৩৬০, আমিনবাজার ৫৫৯, এবং যাত্রাবাড়ী যাবে ৮৯৫টি।

প্রকল্প বাস্তবায়নে সবশেষ তথ্য মতে, এরই মধ্যে আমিনবাজার ও মহাখালীতে মার্কেট নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। যাত্রাবাড়ীতে একটি ব্লকের কেবলমাত্র একটি ছাদ নির্মাণ কাজ বাকি রয়েছে। মাঝে প্রকল্পের মেয়াদ না থাকায় অবশিষ্ট কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছিল না। নতুন করে সময় বাড়ানোয় কাজে গতি এসেছে।

তথ্য সূত্র বলছে, আমিনবাজার কিচেন মার্কেট (গাবতলী) মোট জমির পরিমাণ ১৩ একর। যদিও বেড়ি বাধেঁর পশ্চিম পাশের ২ একর জায়গায় উচ্চ আদালতের রিট পিটিশন থাকায় নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। এ মার্কেটটিতে ১ টি বেজমেন্টে ও একটি ফ্লোর রয়েছে। দোকান সংখ্যা রয়েছে ৬৯৭টি। এখানে কারওয়ান বাজার থেকে স্থানান্তির হবে ৫৪৯ টি দোকান।

মহাখালী পাইকারি কাঁচা বাজারের মোট জমির পরিমাণ ৭.১৭ একর। এখান সাতটি ফ্লোরে একটি বেজমেন্ট ও ছয়টি ফ্লোর রয়েছে। মোট দোকান সংখ্যা ১ হাজার ১৬৫টি। এর মধ্যে কারওয়ান বাজার থেকে স্থানাস্তরিত হবে ৩৬০ টি দোকান।

dhaka

এ ছাড়াও যাত্রাবাড়ী পাইকারি কাঁচা বাজারের মোট জমির পরিমাণ ৫.২১ একর। যেখানে একটি বেজমেন্ট সহ রয়েছে চারটি ফ্লোর। কারওয়ান বাজার থেকে স্থানান্তরিত হবে ৮৯৫ টি দোকান।

ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ তৎকালীন মেয়র আনিসুল হকের সভাপতিত্বে কারওয়ান বাজার মার্কেট সমিতির নেতাদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আড়ৎ মালিক নেতারা যাত্রাবাড়ীতে নবনির্মিত পাইকারি বাজারে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের বিষয়ে লিখিত ঘোষণা দেন। যদিও ব্যবসায়ীরা সে ডাকে সাড়া দেয়নি। বাড়ে অসন্তোষ।

এর আগে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মেয়র আনিসুল হক তেজগাঁও সড়কের ট্রাকের দখলমুক্ত করতে গিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। কিন্তু, তিনি অনড় থাকায় ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন সড়কটি দখলমুক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে সাতরাস্তা থেকে রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন করে সড়ক বিভাজনে লাগানো হয় গাছ। সড়কটি দখলমুক্ত হওয়ায় এর সুফলও পেতে শুরু করে নগরবাসী। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে কারওয়ান বাজার স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় গতি আসবে এমন আশা নগরবাসী করলেও আনিসুল হকের মৃত্যুতে স্থানান্তর প্রক্রিয়া থমকে যায়।

কারওয়ান বাজারের আড়ৎ মালিকদের সাথে কথা বলে জানাযায়, যাত্রাবাড়ীতে নির্মিত নতুন মার্কেটে আড়ৎগুলো যথাযথ নয়। তারা বলছেন, যাত্রাবাড়ীর নতুন মার্কেটের দোকানগুলো সংস্কার করে বড় আকারে আড়তের উপযোগী করতে হবে। অন্যথায় কারওয়ান বাজার এলাকায় দু-তিন একর জায়গার ওপর একটি আধুনিক বহুতল মার্কেট নির্মাণ করতে হবে এবং ১ ও ২ নম্বর সুপার মার্কেট ও কিচেন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ওই মার্কেটে স্থানান্তর করা হবে।

কারওয়ান বাজার আড়তদার শাসমু বলেন, কারওয়ান বাজার ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমাদের কখনোই ছিলো না। একনও নাই। সিটি করপোরশন দীর্ঘ দিন এ বিষয়ে বলে আসছে। তবে আমাদের দাবি এখানেই থেকে ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ করে দিন। তা যদি না হয়, নির্ধারিত স্থানে উপযুক্ত পরিবেশ করতে হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের সহকারী প্রকৌশলী (পুর) নাঈম রায়হান খানের কাছে কারওয়ান বাজার স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি। মোবাইলে তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে পরে এক সময় কথা বলব। পরবর্তীতে একাধিকবার ফোন করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। 

এ প্রসঙ্গে নগর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ঢাকার বাজার ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করবার মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে কারওয়ান বাজার কাচাবাজার ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় অবস্থিত। এখানে সবজি ও কৃষিপণ্য পরিবহনজনিত কারণে এই এলাকায় ট্রাফিক এর উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে পাইকারি কাচাবাজারসমূহ ঢাকার বহিস্থ নগর এলাকায় পরিকল্পিত উপায়ে করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বহিস্থ এলাকা থেকে ঢাকার অভ্যন্তরীণ নগর এলাকায় কাচামাল পণ্য পরিবহনের জন্য সেকেণ্ডারি পরিবহন ব্যবস্থা পরিকল্পনামাফিক গড়ে তুলতে হবে। যাত্রাবাড়ী ও আমিনবাজার ঢাকার বহিস্থ এলাকা হলেও মহাখালী সে অর্থে ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় অবস্থিত। 

কারওয়ান বাজার স্থানান্তর প্রক্রিয়া বিষয়ে বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) গাবতলী পাইকারি মার্কেট পরিদর্শন করে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি বাজার গাবতলীতে স্থানান্তরে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। সে কারণে ব্যবসায়ীদের নতুন স্থানে স্থানান্তর করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাজধানীতে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা ও পাইকারি খুচরা বাজার গড়ে তোলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে ঢাকার কিছুটা দূরে পাইকারি মার্কেটগুলো স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়েছে। আধুনিক ও মানসম্মতভাবে নতুন পাইকারি বাজার গুলো গড়ে তোলা হচ্ছে।

dhaka

মন্ত্রী বলেন, শহরের মধ্যে কতগুলো খুচরা বাজার থাকবে এবং কোথায় কোথায় সেগুলো বসানো হবে ঢাকার মেয়র সেই তালিকা তৈরি করছেন। পাইকারি বাজারগুলো শহরের কিছুটা দূরে স্থানান্তর করা হবে। অপরিকল্পিতভাবে শহরের কোথাও অস্থায়ী বাজার বসানো যাবেনা। যারা অনুমোদনহীন বাজার বসাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি কাঁচাবাজারটি ঢাকার প্রান্তে স্তানান্তরের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত ও আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে পাইকারী কাঁচাবাজার গুলোকে শহরের প্রান্তে নিয়ে যেতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকারি বাজারে আসা পণ্যবাহী গাড়িগুলো শহরে প্রবেশ না করলে যানজট অনেকাংশেই কমে যাবে এবং পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যও হ্রাস পাবে।’

আতিকুল ইসলাম বলেন, পাইকারী ব্যবসায়ীদের সাথেও আমরা আলোচনা করবো। ব্যবসায়ীরা যেন কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় এবং ঢাকাকেও যেন আধুনিক ও পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেটি বিবেচনা করেই পরিকল্পনা করা হবে। আমরা সকল অংশীজনদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে কি কি চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো খতিয়ে দেখে তারপরেই সিদ্ধান্ত নিব বলেও জানান মেয়র।

ডিএইচডি/ একেবি