images

জাতীয়

প্রশান্তির রমনায় অশান্তি ‘ক্যান পার্টি’!

বোরহান উদ্দিন

১৫ জুলাই ২০২২, ০৭:৪৯ পিএম

প্রাকৃতিক পরিবেশে একটু স্বস্তিতে সময় কাটাতে রাজধানীর বাসিন্দাদের পছন্দ রমনা পার্ক। অনেকে পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে আসেন এখানে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সচিবসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সকাল-বিকেল নিয়ম করে শারীরিক চর্চা করেন রমনায়। কিন্তু এমন স্বস্তির মাঝে প্রায়ই মিলছে অস্বস্তির খবর৷ দিনেদুপুরে নির্জন এলাকায় ওঁৎপেতে থাকে বখাটেরা। ফলে দিনেদিনে আতঙ্কের পার্ক হচ্ছে রমনা।

এছাড়াও ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে ঘুরতে এসে 'ক্যান পার্টির' খপ্পরে পড়ে নাজেহাল হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কোনো ধরনের হকারের রমনায় প্রবেশের নিয়ম নেই। কিন্তু কতিপয় আনসার সদস্য ও গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী উৎকোচ নেওয়ার মাধ্যমে ক্যান পার্টির লোকজনকে পার্কে ঢুকতে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এছাড়াও রাতে ভ্রাম্যমাণ পতিতাদেরও আনাগোনা থাকে পার্কে। একটু নির্জন জায়গায় কনডমও দেখা যায় প্রায়ই।

অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় কিছুদিন পরপর আনসারদের বদলি করে নতুনদের আনা হয় বলে জানা গেছে। ঈদের আগেও বেশ কয়েকজন আনসারকে রমনা পার্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যদিও রমনা পার্কের আনসার কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ ক্যান পার্টিসহ পার্কের অভ্যন্তরে সবধরনের অনিয়ম বন্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন৷

এদিকে গত বুধবার ছিনতাইকারী সন্দেহে দুজনকে রমনা থানায় খবর দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও রমনা থানা পুলিশ বলছে, ছিনতাইকারী নয়, তারা দুজন হিজড়াকে ধরা হয়েছিল, যারা মানুষজনকে ডিস্টার্ব করত। শুক্রবার (১৫ জুলাই) সকালেও অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে।

r1

জানা গেছে, বুধবার ভিআইপি গেইট বলে পরিচিত জায়গা থেকে ওই দুই সন্দেহভাজন ছিনতাইকারীকে ধরতে গিয়ে মারুফ নামের একজন আনসার সদস্য আহত হন। পরে রমনা থানায় ফোন করলে পুলিশ এসে দুজনকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে যায়।

রমনা থানায় ফোন করা হলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অপারেশন) ঢাকা মেইলকে বলেন, আনসারের ফোন পেয়ে থানা থেকে পুলিশ গিয়ে দুজনকে আটক করে নিয়ে আসে। যদিও পরে দেখেছি তারা হিজড়া। সন্ধ্যার পর লোকজনকে ডিস্টার্ব করছিল। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর পার্কে কাউকে ঢুকতে না দেওয়ার নির্দশনা আছে। কিন্তু এরা রেলিং টপকে ঢুকে যায়।'

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত এই পার্কে হকার ঢুকবে না এমন সিদ্ধান্ত রয়েছে। কিন্তু দিনভর ক্যানপার্টির লোকজন দর্শনার্থীদের নাজেহাল করে আসছে। বিশেষ করে কপোত-কপোতীদের বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, কয়েকজন যুবক পুরো পার্কের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দিনভর ঘুরে বেড়ান। বিশেষ করে দুপুরের দিকে ব্যায়াম করতে আসা লোকজন কম থাকায় তখন এদের উৎপাত বেড়ে যায়।

দেখা গেছে, এই গ্রুপের লোকজন প্যান্টের সবগুলো পকেটে সফট ড্রিংকসের একাধিক বোতল, শার্টের পকেটে কম দামি চকলেট নিয়ে ঘুরতে থাকেন। হঠাৎ করে লোকজন কম এমন কোনো জায়গায় কোনো ছেলে-মেয়ে বসে থাকলে গিয়ে বোতলটা খুলে ধরিয়ে দেয়।

পরে এই গ্রুপের সদস্যরা রমনার প্যাকেজ ৩০০ টাকা, ৩৯০ টাকা এমন দাম ধরে দর্শনার্থীদের কাছ জোর করে টাকা রেখে দেয়। টাকা না দিলে খারাপ আচরণ করে এই চক্রের সদস্যরা।

এছাড়া রমনার মৎসভবন ও শিশুপার্কের উল্টো দিকের গেটের সামনের ফুচকার দোকান থেকে ক্যান পার্টির সদস্যরা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে দুই গুণ, তিন গুণ দামে বিক্রি করে থাকে।

প্রত্যেক গেটে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে রমনা পার্কে। তাদের সামনে দিয়ে এরা যাওয়া-আসা করলেও কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় না। হকার ও ক্যান পার্টির সদস্যরা জানান, আনসারদের টাকা না গিলে এখানে ঢোকা যায় না।

গণপূর্তের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, 'পার্কের ভেতরে অবকাঠামো, গাছপালা, সৌন্দর্যবর্ধন, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা এসব দেখভাল করে গণপূর্ত। কিন্তু সার্বিক নিরাপত্তার বিষয় আনসার সদস্যরা দেখেন। স্পষ্ট বলা আছে, ক্যান পার্টি তো দূরে থাক কোনো হকার ঢুকবে না। কিন্তু তাদের সামনে দিয়ে ঢুকছে বের হচ্ছে। এর দায় কার?'

শুধু তাই নয়, ক্যান পার্টির মতো আনসারের কিছু সদস্য পার্কে ঘুরে ঘুরে কোনো কপোত-কপোতীদের সন্দেহভাজন মনে হলে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলেন। বিশেষ করে ছেলে মেয়ের বয়সের ব্যবধান দেখলে তাদের টার্গেট করে অসাধু এই আনসার সদস্যরা। এক পর্যায়ে তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করারও অভিযোগ আছে এদের বিরুদ্ধে।

r2

সম্প্রতি প্রতিবেদকের সামনে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের দেয়াল ঘেঁষা সড়কে তিনজন আনসার সদস্য দুই যুবক-যুবতীকে আলাদা করে নাম পরিচয় জানতে চান। পাশাপাশি আরও নানা প্রশ্নে জর্জরিত করায় এক পর্যায়ে ছেলেটি রেগে যান। পরে নিজেকে পুলিশের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার ভাগিনা পরিচয় দিলে আনসার সদস্যরা তাদের ছেড়ে দেন।

অভিযোগ আছে, রমনা পার্কে ডিউটির সুযোগ পেতে কোনো কোনো আনসার সদস্য লাখ টাকার মতো খরচ করতেও দ্বিধা করেন না।

এদিকে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হলে তখন বন্ধ করে দেওয়া হয় রমনা পার্ক। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে খুলে দেওয়া হয় এটি। কিন্তু সকালে এবং বিকেলে নিয়ম করে দুই বেলা গেট খুলে দেওয়ায় দূর-দূরন্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা ভোগান্তিতে পড়েন।

বিশেষ করে শিশুপার্কে ঘুরতে এসে সেটা বন্ধ পেয়ে অনেকেই রমনায় ঢুকতে চান। কিন্তু নির্ধারিত সময় ছাড়া গেটে ঝুলানো থাকে তালা। যা নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ঈদের তৃতীয় দিন বেলা ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী থেকে পরিবার নিয়ে শিশুপার্কে ঘুরতে আসেন শামীম আহমেদ। জানতেন না শিশুপার্ক বন্ধ। পরে রমনায় ঢুকতে গিয়ে দেখেন বন্ধ। এমন অনেক দর্শনার্থী প্রতিদিন গেট থেকে ফিরে যায়।

যদিও এসব বিষয় পুরোপুরি অস্বীকার করে আনসারদের ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। সবাইকে কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে। যদি কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের মহাপরিচালক স্যারও কোনো অনিয়ম সহ্য করেন না।'

এই কর্মকর্তা বলেন, 'ক্যান পার্টির লোক সামনে দেখলেই অ্যারেস্ট। রমনা থানা আমাদের সবসময় সাপোর্ট দেয়। কিন্তু পার্কের এলাকা বড় হওয়ায় অনেক সময় রেলিং টপকে কেউ হয়তো ঢুকে পড়ে, কিন্তু সামনে পড়লেই পুলিশে দিই।'

r3

অভিযোগ আছে, ক্যানপার্টি, হকারদের থেকে উৎকোচের টাকার ভাগ গণপূর্তের সংশ্লিষ্টদের পকেটেও যায়। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রমনা পার্কে দায়িত্ব পালন করা গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী শামসুল ইসলাম। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয় দেখে আনসার সদস্যরা। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানালে তাদের এখান থেকে সরিয়ে দেয়। আমরা পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকি৷ আপনারা দেখবেন এখন পার্কের চেহারা বদলে গেছে।’

শামসুল ইসলাম আরও বলেন, 'গণপূর্তের লোকজনও টাকা নেয় এটা যদি কেউ বলে সে মিথ্যা কথা বলেছে। আমাদের টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই।'

আগের মতো রমনা পার্ক খোলা রাখার কোনো সিদ্ধান্ত আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। আমাদের কিছু জানা নেই।'

সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকোশলী শামীম জামানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে জানা গেছে, তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন।

কথা বলার জন্য চেষ্টা করা হয় গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নাসিম খানের সঙ্গে। তিনিও ফোন ধরেননি।

বিইউ/জেবি