images

জাতীয়

যেভাবে শনাক্ত হলো অনুপ বাউল হত্যাকারীরা

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

১৪ জুলাই ২০২২, ১০:৫০ পিএম

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের অনুপ বাউল। একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। নয়ন নামের একজনের সাথে যৌথ কারবার করতেন। বাউল নয়নকে স্বর্ণ দিতেন। সেই স্বর্ণ নয়ন গহনা বানিয়ে তার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে সরবরাহ করতো। নয়নকে স্বর্ণ দিতে গিয়ে অনুপ বাউলের প্রায় ১০ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে যায়।  এছাড়াও এক পার্টিকে ৬ ভরি স্বর্ণ দেয়ার কাজ পায় অনুপ বাউল।  

স্বর্ণের লোভ এবং বকেয়া টাকা না দেয়ার জন্য নয়ন নানা ছলচাতুরি খুঁজতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে অনুপ বাউলকে হত্যার পরিকল্পনা করে নয়ন। গেল জানুয়ারি মাসে বাসা থেকে ফোনে ডেকে নিয়ে অনুপ বাউলকে নেয়া হয় মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান এলাকায়। এরপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পার্টনার নয়ন অনুপের সাথে পাওনা টাকা নিয়ে জোর করে ঝগড়া বাধায়। এক পর্যায়ে নয়নের সহযোগী রিপন মন্ডল, পিযুষ ও দিলীপকে সাথে নিয়ে রিপনের গ্যারেজের খাটের মধ্যে ফেলে কাপড় দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে অনুপ বাউলকে। 

হত্যার পর লাশ গুম করার জন্য পুঁতে রাখা হয় বালুর মধ্যে। এখানেই শেষ নয়, হত্যাকারীরা ভালো মানুষ সাজার জন্য হত্যার শিকার অনুপ বাউলের পরিবারের সাথে থানাসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে দৌড়াদৌড়িও করে। কোনোভাবেই বুঝতে দেয় না তারা এই হত্যার সাথে জড়িত। এভাবে চার মাস পেরিয়ে যায়। হত্যার শিকার অনুপ বাউলের পরিবার অপহরণ মামলা করে। সে মামলায় কোনো কুলকিনারা পায়নি থানা পুলিশ। 

আলোচিত এই ঘটনায় পুলিশের তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) দায়িত্ব পাওয়ার এক মাসের মাথায় পুরো ঘটনা রহস্য উন্মোচিত হয়। শুধুমাত্র একটি ড্রাম ও তাতে থাকা গ্রিজের পরিমাণের সূত্র ধরে হত্যাকারীরা শনাক্ত হয়। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাস পর অনুপের লাশ উদ্ধার করা হয় ১৬ ফুট নিচে পুঁতে রাখা বালুর নিচ থেকে। ততদিনেও অনেকটাই অক্ষত ছিল সেই লাশ। 

মামলাও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসের শুরুতে অনুপ বাউল বাসা থেকে বের হয়ে যান।  একমাস তার পরিবারের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে থানায় অপহরণ মামলা করেন। সেই মামলাটি করতে সহায়তা করে হত্যাকারীরাই।  এভাবে চার মাস পেরিয়ে যায়। এরপর বিষয়টি তদন্ত ভার পড়ে পিবিআইয়ের হাতে। 

পিবিআইয়ের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তারা তদন্তে নেমে প্রথমে অনুপ বাউলের ফোন কল লিস্টের সূত্র ধরে এগোতে থাকে। এক পর্যায়ে দেখা যায়, তার ব্যবসায়িক পার্টনার নয়ন ঘটনার দিন তাকে ডেকে নিয়েছিল। এরপর থেকে অনুপ বাউল নিখোঁজ। সেই ফোন কলের সূত্র ধরে প্রথমে খুঁজে বের করা হয়,তার ব্যবসায়িক পার্টনার নয়নকে। নয়ন কোনোভাবে এ হত্যার সাথে জড়িত স্বীকার করছিল না। পরে তার দেয়া তথ্যমতে হত্যায় সহযোগিতাকারী রিপন মণ্ডল (৩২), পিযুষ  করাতি (২৫), দিলীপকে গ্রেফতার করে পিবিআই। এদিকে পিবিআই গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পারে, এই হত্যাকাণ্ডের পর লাশ একটি ড্রামে ভরে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই নদীর পাড়ের বালুর মাঠে। 

যেভাবে অনুপ বাউলকে হত্যা ও তার লাশ গুম করা হয়েছিল

এই হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিল বাউলের ব্যবসায়িক পার্টনার নয়ন।‌ ঘটনা দিন সে অনুপ বাউলকে নয়নের সহযোগী রিপনের গ্যারেজে ফোন করে ডেকে নেয়। অনুপ বাউল সেখানে পৌঁছানোর পর তার নানার সাথে ১৫ মিনিট ছোট ভাইয়ের বিয়ের বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করে। এক পর্যায়ে নয়নের সাথে থাকা তিনজন সুযোগ বুঝে তাকে কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর তারা সেই লাশ গুম করার জন্য সকাল থেকে অপেক্ষায় থাকে। বিকেলে একটি অটো ভাড়া করে ড্রামে ভরা হয় লাশ। অটো রিকশায় করে সেটি নিয়ে যাওয়া হয় মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান এর একটি চরে। যেখানে আগে থেকে নয়নের ভেক্যু মেশিন রাখা ছিল। যে মেশিনটির মালিক রিপন মণ্ডল। এরপর সুযোগ বুঝে ১৬ ফুট গর্ত করে ড্রাম থেকে লাশ বের করে পুঁতে রাখা হয়। 

হত্যাকারীরা যা জানিয়েছে
এ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল পার্টনার নয়ন। তাকে হত্যায় সহায়তা করে রিপন মন্ডল, পিযুষ ও দিলীপ। তারা তিনজন মিলে অনুপকে হত্যার পর  বাউলকে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে রাখে। আর পুঁতে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয় বড় একটি ভেক্যু মেশিন। হত্যার পর যে ড্রামটি লাশ বহনে নেয়া হয়েছিল সেটি রিপন তার গ্যারেজে আনার পর কয়েকদিন রেখেছিল কিন্তু বারবার সেদিকে চোখ যেত। এতে তার সেই কথাগুলো মনে পড়তো। এ কারণে ড্রামটি এক ভাঙ্গারীর দোকানে ৭৫০ টাকায় বিক্রি করে দেয় সে। 

ড্রামে গ্রিজের পরিমাণে সন্দেহ, বেরিয়ে এলো হত্যাকারীরা
প্রধান আসামি নয়নকে গ্রেফতারের পর কোনোভাবে লাশ গুম করার কাজে ড্রামের সন্ধ্যান মিলছিল না। এরই মধ্যে সন্ধ্যান মেলে সেই অটো চালকের। অটো চালক তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানায়, সেদিন দু'জন মিলে অটোতে করে ড্রাম নদীর পাড়ে নিয়েছিল। বাকী দু'জন মোটরসাইকেলে সেখানে যায়। এরপর ওই চারজন মিলে ড্রামটি কোনোভাবে নামাতে পারছিল না। এজন্য চালকের সহায়তা নিয়েছিল তারা। চালক জানায় ড্রামটি নামানোর সময় অনেক ওজন ছিল। এবার আরো সন্দেহ বেড়ে যায় তদন্ত সংশ্লিষ্টদের। চারজনকে গ্রেফতারের পর তাদের আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তারা। তখন ভুলভাল তথ্য দিতে থাকে। নয়ন বলে ড্রামটিতে গ্রিজ নেয়া হয়েছিল। যা ভ্যাক্যু মেশিনকে সচল রাখে। আর প্রতিদিন ৭০ কেজি গ্রিজ লাগতো তাদের। এবার ড্রামে কতটুকু গ্রিজ লাগে তা বের করেন তদন্তকারীরা। দেখা যায়, একটি ভ্যাক্যুতে দিনে এক থেকে বড় জোর দেড় কেজি গ্রিজ লাগে। কিন্তু ড্রামটিতে গ্রিজ ধরবে ২১০ কেজিরও বেশি। সে হিসেবে তাদের কারও তথ্যই মিলছিল না। এক পর্যায় তারা স্বীকার করে সেই ড্রামটিতে লাশ ভরে নদীর পাড়ে এনে তারা ভ্যাক্যু দিয়ে গর্ত করে তা পুঁতে রেখেছিল। 

হত্যার পর গোসল করে নয়ন
হত্যাকাণ্ড শেষ করার পর মূল হোতা নয়ন সেই বালুর চরের পাশে থাকা তার বন্ধু পিংকুর বাসায় যায় এবং সেখানে সে গোসল করে। কিন্তু পিংকু নয়নের বন্ধু হলেও কোনদিন সেখানে গোসল করতে যায়নি। গোসল করার সময় নয়নকে বেশ বিধ্বস্ত দেখতে পায় তার বন্ধু পিংকু। এতে তার মনে নানা সন্দেহ দেখা দেয়। এই মামলায় পিংকুও একজন অন্যতম সাক্ষী। অন্যরা যে যার মতো করে বাসায় চলে যায়।

মুল আসামি নয়ন যা জানিয়েছে
ঘটনার দিন অনুপ, অনুপের কর্মচারী রঘু ও সে মিলে  ছয় ভরি সোনার অলঙ্কার নিয়ে মাদারীপুর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেদিনই তাকে রিপনের গ্যারেজে ডেকে নেয়। সেখানে অনুপ ছোট ভাইয়ের বিয়ে বিষয়ে ১৫ মিনিট তার নানার সাথে কথা বলে। তার কথা বলা শেষ হলে চারজন মিলে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করে। লাশ গুমের জন্য ভেক্যু মেশিন দিয়ে ১৬ ফুট মাটির নিচে লাশ পুঁতে রাখে। হত্যার পর নিহত অনুপের পরিবারকে বলেছিল,  মামাতো অনুপকে (মামা ডাকতো) আসার কথা ছিল কিন্তু আসলো না। ঠাণ্ডা মাথায়,পরিবারের সাথে থানা পর্যন্ত যায় এবং তাদেরকে অপহরণ মামলা করার পরামর্শ দেয় নয়ন। ।

তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ঢাকা জেলার পিবিআইয়ের এসআই সালেহ ইমরান ঢাকা মেইলকে বলেন, কোনোভাবে এ হত্যার সাথে জড়িত নয়ন তার সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করছিল না। কিন্তু ড্রাম নিয়ে প্রশ্ন করলে নানা তথ্য দিতে থাকে। পরে কারো কথায় মিলে না। তা থেকে সন্দেহ বেড়ে যায়। এক পর্যায় তারা স্বীকার করে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রায় ৫ মাস পর নদীর পাড়ে পুঁতে রাখা ১৬ ফুট বালুর নিচ থেকে অনুপ বাউলের লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার দিন অনুপের মোবাইল লোকেশন ছিল রিপনের গ্যারেজে।

তিনি আরো বলেন, নয়ন অনুপকে রিপনের গ্যারেজে ডেকে নিয়ে এক সাথে চা পান করে। এরপর তারা ইয়াবা দিয়ে নেশা করে। পরে তারা তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। প্রতিদিন রিপনের গ্যারেজটি খোলা থাকলেও সেদিন তা বন্ধ ছিল। এটি ছিল তদন্তের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। তারা লাশটি ড্রামে করে বালুর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পরও আধা কিলোমিটার দূরে ভ্যাক্যুটি রাখা ছিল। সেটির কাছে তারা ড্রামটি গড়গড়িয়ে নিয়ে যায়। তারা ড্রামের ব্যাপারে কেউ বলেছে রিপনের গ্যারেজে, কেউ বলেছে রেখে আসছিল। এইড্রাম নিয়ে ভুল তথ্যই ছিল গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। 

 এই তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, তারা ভেবে নিয়েছিল ঘটনাটি চাপা পড়ে যাবে। এমনকি পিবিআইতে যখন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল সেই সময়গুলোতেও তারা অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। তারা তাকে খুনের পর ঠাণ্ডা মাথায় থানা পুলিশ থেকে সব কিছু সামাল দিয়েছিল। এমনকি নয়নকে বিভিন্ন সংস্থা ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে কোনোভাবে এ হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি। কিন্তু ড্রামের খোঁজ পাওয়ার পর তাতে যে গ্রিজ বহনে গড়মিল তথ্য পাওয়া গেলে তখন আর কোনো নাটক সাজাতে পারেনি। মুলত একটি ড্রাম ও ড্রামে গ্রিজের পরিমাণে সন্দেহ থেকে হত্যার আসল রহস্য বেরিয়ে আসে। 

এমআইকে/ একেবি