মোস্তফা ইমরুল কায়েস
৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪১ পিএম
গল্পটি ১৯৮৭ সালের। তখন ঢাবির শামসুন্নাহার হলে ছাত্রদল শক্তিশালী অবস্থানে ছিল না। দলকে চাঙ্গা করতে হলে ছাত্রদল নেত্রীদের উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল। তখনই হলের নেত্রীরা ঠিক করলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করবেন। সেই খবর দিতে তারা ধানমন্ডির অফিসে গিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে।
খবরটি শোনার পর ম্যাডাম মৃদু হাসলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ব্যাগ থেকে ৫০০ টাকা বের করে শামসুন্নাহার হলের ছাত্রদল নেত্রী শাহীন আক্তার শিমুলের হাতে তুলে দেন। সেই মুহূর্তের স্মৃতি আজও শিমুলকে তাড়া করে।

মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেলে বসুন্ধরা এভারকেয়ার হাসপাতালে শত শত মানুষ জড়ো হন। সেখানে বিপরীত সড়কে দাঁড়িয়ে শিমুল স্মৃতিচারণ করেন।
তিনি বলেন, ১৯৮৭ সালে ম্যাডামের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। তখন ঢাবির শামসুন্নাহার হলের জিএস নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ছাত্রদলের অবস্থা ভালো ছিল না। আমরা একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেই। সেই খবর দিতে গিয়েছিলাম।
গিয়ে দেখি তিনি বসে আছেন। আমরা বললাম, ম্যাডাম, আমরা একটি অনুষ্ঠান করব, আপনি দোয়া করবেন। ম্যাডাম মিটিমিটি হাসছিলেন। আমাদের টাকা চাইতেও লজ্জা লাগছিল। এরপর তিনি ব্যাগ থেকে ৫০০ টাকা বের করে দিয়ে বললেন, এই টাকাটা রাখো, আর বাকি টাকা তারা ম্যানেজ করে দেবে। তখন তার সামনে ছিলেন তৎকালীন ঢাবি ছাত্রদল নেতা আমানুল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন।
তিনি আরও বলেন, ম্যাডাম আমাদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি প্রতিদিন ৫০০ টাকা নিয়ে আসি শাড়ি তুলবো বলে, কিন্তু তোমাদের যন্ত্রণায় আর পারি না, প্রতিদিনই তোমাদের সেই টাকা দিয়ে দিতে হয়।
শাহীন আক্তার বলেন, ওই শাড়িতে লেখা ছিল ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া’। আজাদ নামে এক বিএনপি নেতা শাড়িটি তৈরি করেছিলেন ম্যাডামের জন্য। সেই শাড়ির কথা ম্যাাডাম সেদিন বলছিলেন। তখন ম্যাডামের আচরণ, হাসি এবং কথাবার্তা দেখে মনে হয়েছিল, তিনি আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো ঐশ্বরিক মানবী। সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে করতে তিনি বারবার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন।
শাহীন আক্তার শিমুল ছাত্রদলের প্যানেল থেকে পরবর্তীতে ঢাবির শামসুন্নাহার হলের নির্বাচিত জিএস হন। খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে তার গভীর শোক। তিনি প্রশ্ন তোলেন, খালেদা জিয়ার মতো আর কোনো মানুষ কি বাংলাদেশ পাবে, যার আচরণে ভদ্রতা, নম্রতা ও বিনয় ছিল। খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন।

তার একটি ছোট নজির তুলে ধরে শিমুল বলেন, আমরা একদিন গুলশান অফিসে গিয়েছিলাম। সালটা হবে ২০১৬ সালের দিকে। একটি জেলা থেকে অনেক ছেলে এসেছিল। তারা মিছিল করে ম্যাডামের বাসার সামনে রাত ১টা পর্যন্ত অবস্থান করেছিল। ম্যাডাম তার অফিসের করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা বলছিলাম, ম্যাডাম ভেতরে যান। তখন তিনি বললেন, না, আমি ভেতরে গেলে ওদের পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। আগে আমি ভাবতাম উনি হয়তো অভিনয় করেন, নেতাকর্মীদের প্রতি তেমন ভালোবাসা নেই। কিন্তু সেদিন আমার ভুল ভাঙে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, প্রত্যেকটা ছেলে চলে যাওয়ার পরই ম্যাডাম ভেতরে ঢুকলেন। তার নেতাকর্মীদের প্রতি এই মায়া এবং ভালোবাসা ভাষায় বোঝানো যাবে না। ঘটনা খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগের।
দলের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি স্মৃতি তুলে ধরে শিমুল জানান, ১৯৮৯ সালে ঢাবির শামসুন্নাহার হলে ডাকসুর প্যানেল পরিচিতির একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সেবার প্রথমবারের মতো হলে যান খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া আসবেন জেনে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা খুব আনন্দিত ছিল। কিন্তু সেদিন রাতে খালেদা জিয়া হলের গেটে পৌঁছানোর পরপরই বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। যারা এই কাজ করেছিল তারা সবাই আওয়ামী লীগের লোকজন। তারা খালেদা জিয়াকে গেটে আটকে রেখে সেই কাজ করে। ফলে খালেদা জিয়া হলের ভেতরে ঢুকতে পারেননি। কিন্তু হাল ছাড়েননি। পরে তিনি টিএসসিতে চলে যান। প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে বসে থেকে পরবর্তীতে হলে প্রবেশ করেন।
এআইকে/এআর