images

জাতীয়

মানবতার দেয়াল: প্রয়োজন হলে নিন, সামর্থ্য থাকলে দিন

মাহফুজুর রহমান

৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০৫ পিএম

রাস্তার পাশে একটি দেয়াল। দেয়ালে ঝুলছে বই, জামা, জুতা, স্কুল সামগ্রী, খাবার। পাশে লেখা রয়েছে প্রয়োজন হলে নিন, সামর্থ্য থাকলে দিন।

যে কোনো বয়সী মানুষ নির্ভয়ে এগিয়ে আসে, প্রয়োজনীয় জিনিস বেছে নেয়। এখানে দান ও গ্রহণকে কেউ ছোট বা বড় ভাবতে বাধ্য নয়। মানবতার দেয়াল শুধু বস্তু ভাগাভাগি নয়, এটি একটি নীরব সামাজিক চুক্তি, যা মানবিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত প্রকাশ।

বিশ্ব থেকে বাংলাদেশে

মানবতার দেয়ালের ধারণা প্রথম দেখা যায় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। ২০১৩ সালে ইরানের কিছু শহরে ঝুলন্ত দেয়ালের মাধ্যমে শীতবস্ত্র বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৪ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এই ধারণা দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। সমাজে দান ও গ্রহণের মধ্যে সম্মান বজায় রাখার ধারণাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। অল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এটি বিস্তৃত হয়। কোথাও এটি স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ, কোথাও নাগরিক সংগঠন বা সাধারণ মানুষের যৌথ প্রচেষ্টা।

picture-2

বাংলাদেশে মানবতার দেয়ালের প্রচলন শুরু হয় ২০১৬ সালে। ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে স্বেচ্ছাসেবীরা প্রথম দেয়াল স্থাপন করেন। এগুলোতে ঝুলানো হয় ব্যবহারযোগ্য জামা-কাপড়, জুতা, বই ও স্কুল সামগ্রী। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে এটি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে আসে এবং দ্রুত শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়।

সার্বক্ষণিক প্রয়োগ ও গুরুত্ব

মানবতার দেয়ালের বিশেষত্ব হলো এটি কোনো নির্দিষ্ট সময় বা মৌসুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শীতকালে কাপড়, বর্ষায় বন্যার সামগ্রী, পরীক্ষার আগে বই-খাতা, যে কোনো সময় শিশুদের খেলনা বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী—সবই এতে রাখা যায়।

একজন স্কুলপড়ুয়া পড়াশোনার বই নিতে পারে, একজন দিনমজুর শিশুর জন্য জুতা বেছে নিতে পারে, একজন মা প্রয়োজনমতো জামা সংগ্রহ করতে পারে। কোনো প্রক্রিয়া বা অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। এটি মানুষের আত্মসম্মান বজায় রাখে।

picture-2

দাতার জন্যও এটি একটি সহজ ও মানসিকভাবে তৃপ্তিকর উদ্যোগ। আলাদা করে কাউকে খুঁজতে হয় না, কারও যোগ্যতা যাচাই করতে হয় না। দেয়ালই হয়ে ওঠে মধ্যস্থতাকারী।

বাংলাদেশে মানবতার দেয়াল

বাংলাদেশে মানবতার দেয়ালের সবচেয়ে পরিচিত চিত্র হলো শীতকালের কাপড়—কোট, সোয়েটার, জ্যাকেট, শাল ইত্যাদি। অন্যান্য ধরনের জিনিস যেমন খাবার, বই বা খেলনা এখনও তেমনভাবে প্রচলিত নয়। দাতারা সাধারণত ব্যবহারযোগ্য শীতবস্ত্রই দেয়ালে রাখেন, কারণ এটি মৌসুমভিত্তিক এবং সরাসরি মানুষের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।

ফলে বাংলাদেশের মানবতার দেয়াল এখন মূলত শীতবস্ত্র বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যদিও ধারণা ও দর্শনটি সারাবছরের জন্য প্রযোজ্য। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেয়ালটি অসহায় মানুষের জন্য কার্যকর ও মানবিক সহায়তার একটি উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

নগর জীবনে মানবতার দেয়ালের প্রভাব

নগর জীবনে মানুষ ক্রমেই একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে, তা জানা নেই। মানবতার দেয়াল সেই বিচ্ছিন্নতার মাঝে সংযোগ স্থাপন করে। এটি মনে করিয়ে দেয়, আমরা একা নই।

দেয়ালটি ধনী ও দরিদ্রের ভেদ মুছে দেয়। আজ যে মানুষ দান করছে, কাল সে-ও হয়তো প্রয়োজনে কিছু নেবে। এই অনুভূতিই মানবতার দেয়ালের নৈতিক ভিত্তি।

সীমাবদ্ধতা ও বিশ্বাস

পুরোপুরি মানুষের বিবেকের ওপর নির্ভরশীল হলেও মানবতার দেয়াল টিকে আছে। কোথাও অপ্রয়োজনীয় জিনিস ঝুলছে, কোথাও কেউ বেশি নিয়ে নিচ্ছেন—তবু এটি সমাজে বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধের একটি সংস্কৃতি তৈরি করেছে।

মানবতার দেয়াল মানুষের মনে শেখায়, মানবতা কোনো বড় ঘোষণা বা বড় দানের বিষয় নয়। এটি হতে পারে শুধু একটি বই, একটি জামা, একটি জুতা বা একটি খাবারের প্যাকেট।

মানবিক শিক্ষা ও সামাজিক সংযোগ

মানবতার দেয়াল শুধু সামগ্রী ভাগাভাগি নয়, এটি মানুষের মধ্যে বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতা গড়ে তোলে। যখন রাষ্ট্র বা সংস্থার বাইরে মানুষ একে অপরকে সাহায্য করে, তখন সমাজে এক ধরনের নীরব পরিবর্তন ঘটে।

বাংলাদেশে ২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ আজ দেশের নাগরিক সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটি শেখায়, সহানুভূতি, সদিচ্ছা ও মানবিক দায়বদ্ধতা ছোট কাজের মধ্যেও প্রকাশ পেতে পারে।

একটি দেয়াল, একটি বার্তা

মানবতার দেয়াল আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবতা কোনো বড় দান বা ঘোষণা নয়। এটি ছোট কাজের মধ্যেও ফুটে ওঠে। সারাবছর, যে কোনো সময়ে, যে কোনো পরিস্থিতিতে—প্রয়োজনে কেউ নেবে, আর অন্য কেউ দেবে। এই সহজ ও মানবিক বিনিময়ই সমাজকে শক্তিশালী করে।

দেয়াল শুধু আলাদা করে না, বরং মানুষকে একত্রিত করতে পারে। এটি আমাদের শেখায়, মানবিক সহায়তা ও ভালোবাসা কোনো সীমাবদ্ধ সময়ের মধ্যে আবদ্ধ নয়। এটি প্রতিদিন, সারাবছর, সর্বক্ষণ প্রযোজ্য।

এম/এআর