মোস্তফা ইমরুল কায়েস
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৫৬ পিএম
বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে কিছু কিছু ঘটনা সাময়িক আলোচনার গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় বিতর্ক, সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও জনমনে গভীর দাগ কেটেছে। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল, সেগুলোর মধ্যেই রয়েছে রাজধানীর বাড্ডায় বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী লালচাঁদ ওরফে সোহাগকে কুপিয়ে ও পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা, শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে প্রকাশ্যে গুলি, ময়মনসিংহে দিপু চন্দ্র দাসকে ধর্ম অবমাননার গুজব তুলে পিটিয়ে হত্যা, মোহাম্মদপুরে মা ও মেয়েকে নির্মমভাবে খুন এবং বছরের শেষে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদী হত্যা।
এর মধ্যে বিশেষ করে দিপু চন্দ্র দাস ও শরীফ ওসমান হাদী হত্যাকাণ্ড দেশে–বিদেশে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। বছরজুড়ে আলোচিত সেই সাত হত্যাকাণ্ড নিয়ে এই সালতামামি।
১. বাড্ডার বিএনপি নেতা সাধনকে প্রকাশ্যে হত্যা
চলতি বছরের শুরুর দিকে ২৫ মে রাজধানীর বাড্ডায় বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিন রাত সোয়া ১০টার দিকে মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। তিনি ছিলেন গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং পেশায় একজন ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ী। তাকে গুলি করে হত্যার ঘটনাটি দেশজুড়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল।
যেভাবে সাধনকে গুলি করে হত্যা করা হয়:
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার সময় বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধন গুদারাঘাট ৪ নম্বর রোডে সাবেক কমিশনার কাইয়ুমের কার্যালয়ের বিপরীতে একটি চায়ের দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। এমন সময় মুখে মাস্ক পরা দুজন দ্রুত গতিতে হেঁটে এসে তাকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি করে পালিয়ে যায়। এ সময় তারা ফাঁকা গুলি করতে করতে চলে যাওয়ায় আশপাশের কেউ এগিয়ে আসার সাহস করেনি। মাত্র ৪ সেকেন্ডের মধ্যে ৫-৬ রাউন্ড গুলি ছোড়ে তারা। গুলির আঘাতে কামরুলের বুক, পিঠ ও ঘাড়ের ডানে–বামে একাধিক গুলি লাগে। পরে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে আলোচিত এই ঘটনায় নিহতের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার পরদিন ২৬ মে বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে বাড্ডার একটি পরিত্যক্ত গ্যারেজ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করে, যা এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে ধারণা পুলিশের।
শুটার ও সহযোগী শনাক্ত হলেও গ্রেফতার হয়নি কেউ:
জানা গেছে, এই ঘটনার সাত মাস অতিবাহিত হতে চলেছে কিন্তু এখনো পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে শুরুর দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দুজন শুটারকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেছে বলে জানিয়েছিল। শুটার ফয়সাল (মূল ঘাতক) ও রাসেল ওরফে কালা রাসেল। সিসিটিভি ফুটেজে সরাসরি গুলি করতে দেখা গেছে ফয়সালকে। সে স্থানীয় একজন চিহ্নিত অপরাধী। তার সহযোগী ছিল রাসেল। রাসেল মোটরসাইকেল নিয়ে ব্যাকআপ হিসেবে পাশে ছিল।
বাড্ডা থানা পুলিশ জানিয়েছে, আসামিরা দেশের ভেতরেই গা–ঢাকা দিয়ে আছে এবং তাদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
হত্যার নেপথ্যে তিন কারণ:
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ড তদন্তে নেমে পুলিশ সম্ভাব্য তিনটি কারণ খুঁজে পায়। তার মধ্যে প্রথমেই ছিল স্থানীয় রাজনীতি ও দলীয় পদ নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। দ্বিতীয় ছিল বাড্ডা এলাকায় ইন্টারনেট ও ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং তৃতীয় ছিল প্রভাবশালী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি।
২. পুরান ঢাকায় পাথর ছুড়ে লালচাঁদ হত্যাকাণ্ড
বছরের মাঝামাঝি পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল এলাকায় মিডফোর্ট হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ব্যবসায়ী লালচাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যা ঘটনাটি ছিল একটি নৃশংস ও আলোচিত ঘটনা। চলতি বছরের ৯ জুন সন্ধ্যায় সোহাগকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার সময় পুলিশকে অনেকে ফোন করেও তারা কিছু করতে পারেনি। পরে এসে লাশ উদ্ধার করে। সেই সঙ্গে এই ঘটনায় জড়িত মাহমুদুল হাসান মহিন এবং তারেক রহমান রবিনকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে পুলিশ। তাদের দেওয়া তথ্যমতে নরসিংদী থেকে রাজিব ও সাবিজকে এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে নান্নু কাজীকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ১৯ জনকে গ্রেফতার করেছে বলে জানা গেছে।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ডিএমপি জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের পেছনে ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন ও ব্যবসায়িক বা অর্থনৈতিক বিরোধ ছিল। মামলায় নাম থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে কিছুজনের রাজনৈতিক সংগঠন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাও তদন্তে উঠে এসেছে। এ ঘটনার পর বিএনপি কিছু কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বলে জানা গেছে।
যেভাবে হত্যা করা হয় লালচাঁদ ওরফে সোহাগকে:
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকারীরা প্রথমে সোহাগকে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মারতে মারতে বের করে নিয়ে আসে। এরপর তারা তাকে কুপিয়ে আহত করে। একপর্যায়ে সোহাগ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লে তারা পাথর ছুড়ে তাকে হত্যা নিশ্চিত করে। এ হত্যাকাণ্ডের পর পাথর ছুড়ে হত্যার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঘটনার পরপরই পুলিশ অভিযান শুরু করে এবং একাধিক আসামিকে গ্রেফতার করে।
৩. প্রকাশ্যে গুলি করে শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন হত্যাকাণ্ড:
রাজধানীর পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে গেল ১০ নভেম্বর সকালে প্রকাশ্যে গুলিতে নিহত হন তারিক সাইফ মামুন (৫৫)। তারিক মামুন পুলিশের তালিকায় একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। ঘটনাস্থল ছিল ব্যস্ত সড়কের পাশে, হাসপাতালের মূল ফটকের কাছে। ফলে এলাকাবাসী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং আলোচিত হয়ে ওঠে এই হত্যাকাণ্ড।
অভিযোগ রয়েছে, নিহত মামুন নব্বইয়ের দশকে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল।
শুরুর দিকে মামুনকে শনাক্ত করা গেলেও তার পরিচয় অজানা ছিল। কিন্তু পরে পুলিশ তদন্তে তাকে একজন তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে। অতীতে তিনি একাধিক গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি আবারও অপরাধজগতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন বলে তদন্তে উঠে আসে।
মামুনকে যেভাবে হত্যা ও যারা জড়িত:
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার সময় মোটরসাইকেলে করে আসা দুইজন অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত মামুনকে লক্ষ্য করে পরপর গুলি ছোড়ে। তিনি পালানোর চেষ্টা করেন কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। পরে দ্রুত তাকে উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, হামলাকারীরা মুখ ঢেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরে এ ঘটনায় পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে দুজন সরাসরি গুলি চালায় এবং বাকি তিনজন পরিকল্পনা, সহায়তা ও পালাতে সহযোগিতা করে। জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, অর্থ লেনদেন এবং নির্দেশদাতাদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল গ্যাং দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের শত্রুতা। মামুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী একটি অপরাধী চক্রের বিরোধ চলছিল। বিশেষ করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ, প্রভাব বিস্তার ও আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব থেকেই তাকে টার্গেট করা হয়। প্রতিপক্ষ একটি গ্যাং অর্থের বিনিময়ে পেশাদার খুনিদের দিয়ে এই হামলা চালায়। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডের পেছনে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের নেতৃত্ব ও নির্দেশনা ছিল।
৪. জুলাই যোদ্ধা শরীফ ওসমান হাদী হত্যাকাণ্ড
বছরের শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও বছরের শেষ প্রান্তে এসে জুলাই আন্দোলনের সম্মুখসারির নেতা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদী হত্যাকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। এই হত্যাকাণ্ড শুধু একজন নেতার মৃত্যু নয়, বরং সমসাময়িক বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর বিয়োগান্তক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম ছাত্রনেতা শরীফ ওসমান হাদী (শরীফ ওসমান বিন হাদী নামেও পরিচিত) ২০২৫ সালের ১২ ডিসেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোড দিয়ে রিকশায় যাওয়ার সময় সশস্ত্র হামলার শিকার হন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, একটি মোটরসাইকেলে আসা দুইজন সন্ত্রাসী খুব কাছ থেকে তার মাথায় গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায়। সে সময় তিনি ঢাকা-৮ আসন থেকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারণায় সক্রিয় ছিলেন।
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, পরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৫ ডিসেম্বর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের নিউরোসার্জিক্যাল আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার দিন পর, ১৮ ডিসেম্বর রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হাদির জানাজা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে:
হাদির জানাজায় জনসমাগম তার জনপ্রিয়তার স্পষ্ট প্রমাণ দেয়। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় অনুষ্ঠিত জানাজায় কয়েক লাখ মানুষের অংশগ্রহণ দেশের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। অনেকেই এই জনসমাগমের তুলনা করেছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জানাজার সঙ্গে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের নিকট তাকে দাফন করা হয়। দাফনের পরও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তার কবর জিয়ারত করতে ভিড় করছেন। রাষ্ট্র তার মৃত্যুর পরদিন একদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করে।
এখন পর্যন্ত যারা গ্রেফতার, শুটার ফয়সালসহ দুজন ভারতে:
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে বলে দাবি করেছে। তাদের মধ্যে ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন এবং চারজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে মূল শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ ও তার সহযোগী আলমগীর শেখ এখনো পলাতক। পুলিশ জানিয়েছে, তারা ঘটনার পর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছে।
পুলিশ যা বলছে:
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ভাষ্যমতে, এটি একটি সুপরিকল্পিত কন্ট্রাক্ট কিলিং। হত্যাকাণ্ডে বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রমাণ মিলেছে, ফয়সালের ব্যাংক হিসাবে ২১৮ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে ইন্টারপোলের মাধ্যমে প্রধান আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
নেপথ্যের কারণগুলো যা মনে করা হচ্ছে:
তদন্তকারী সংস্থা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, কণ্ঠরোধ, আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এবং আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ — এই তিনটি কারণ প্রধানভাবে কাজ করে থাকতে পারে। এদিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে চার্জশিট দাখিলের আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন। আগামী মাসের ৭ জানুয়ারি এই রিপোর্ট প্রদান করা হবে।
৫. ময়মনসিংহে আলোচিত দিপু চন্দ্র হত্যাকাণ্ড
বছরজুড়ে নানা হত্যাকাণ্ডের খবর পত্রপত্রিকায় এলেও কোনোটি তেমন আলোচনার জন্ম দেয়নি। কিন্তু বছরের শেষের দিকে এসে ময়মনসিংহের ভালুকার গার্মেন্টস কর্মী দিপু চন্দ্র দাস (২৭) হত্যাকাণ্ড ব্যাপক সমালোচনা ও আলোচনার জন্ম দেয়। যা শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনার ঝড় তোলে। এ ঘটনায় সংখ্যালঘু নিরাপত্তা ও মব লিঞ্চিং নিয়ে বড় প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে।
দিপু চন্দ্র দাস জামিরদিয়া ডুবালিয়াপাড়া এলাকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড কারখানার শ্রমিক ছিলেন। তিনি তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়নের মোকামিয়াকান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে।
যেভাবে ঘটনার শুরু ও প্রেক্ষাপট:
জানা গেছে, দিপু চন্দ্র দাস ছিলেন ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত। গত ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তার সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ ও পদোন্নতি নিয়ে বিরোধ ও বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর তাকে কারখানা থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে তারই সহকর্মীরা তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে লোকজন জড়ো করে এবং তাকে জনতার হাতে তুলে দেয়। এতে উত্তেজিত জনতা তাকে মারধর করে। উত্তেজিত জনতা দিপুকে ধরে পিটিয়ে হত্যার পর তার মরদেহ গাছে ঝুলিয়ে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এ ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বর্বরতা প্রকাশ পায় এবং সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় ওঠে।
এ ঘটনার পরে পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, দিপু কোনো ধর্ম অবমাননা করেনি। মূলত তাকে হত্যার জন্যই এমন গুজব ছড়ানো হয়েছিল এবং এ কাজটি তারই সহকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে করেছিল।
এ ঘটনায় যারা জড়িত:
এ ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব তদন্তে নামে। এরপর তারা অন্তত ১২ জনকে গ্রেফতার করে। এখন পর্যন্ত গ্রেফতারকৃতরা হলেন আশিকুর রহমান, কাইয়ুম, মানিক মিয়া, এরশাদ আলী, নিজুম উদ্দিন, আলমগীর হোসেন ও মীরাজ হোসেন আকন, যারা ওই কোম্পানির বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন।
নেপথ্যের কারণ:
প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি ধর্ম অবমাননা বলে প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে উঠে আসে, এই দাবির স্বপক্ষে কোনো দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মূলত দিপু চন্দ্র দাস দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। উৎপাদন বাড়ানো, ওভারটাইম, কাজের পরিবেশ ও সুযোগ–সুবিধা নিয়ে তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতেন। এতে মালিকপক্ষের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ কারণেই তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং একপর্যায়ে চাকরি ছাড়তে চাপ দেওয়া হয়।
৬. মোহাম্মদপুরে জোড়া হত্যাকাণ্ড:
বছরের শেষের মাস ডিসেম্বরে দেশে কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল গত ৮ ডিসেম্বর সকালে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের একটি বাসায় মা ও মেয়েকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা। এই জোড়া খুন সারা দেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। কারণ বাসার গৃহকর্মী এ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে পলাতক ছিল। এ ঘটনায় নিহতরা হলেন মা লায়লা আফরোজ (৪৮) এবং তার ১৫ বছর বয়সী মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ। ঘটনার পর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় তাদের গলার কাছে বহু ছুরিকাঘাতের ক্ষত ছিল। পুলিশের তথ্যমতে, লায়লার গায়ে প্রায় ৩০টি, মেয়ের গায়ে কমপক্ষে ৬টি ছুরিকাঘাত ছিল।
হত্যার পর বোরকা পরে পালিয়ে যায় খুনি:
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল ওই বাসার গৃহকর্মী। মা ও মেয়েকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর সেই গৃহকর্মী বোরকা পরে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, যা পরে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে উঠে আসে। হত্যাকাণ্ডের চার দিন আগে ওই বাসায় কাজ নেয় সে।
যেভাবে শনাক্ত হলো খুনি:
এ ঘটনায় নিহতের স্বামী এজিএম আজিজুল ইসলাম বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। সেই মামলার তদন্তে নামে পুলিশ। তারা গত কয়েক মাসে মোহাম্মদপুর এলাকায় চুরির ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে শুরু করে। এরপর কয়েক শত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও ছবি বিশ্লেষণ করে পুলিশ আয়েশা নামে এক গৃহকর্মীকে মূল সন্দেহভাজন হিসেবে শনাক্ত করে।
যেভাবে গ্রেফতার:
খুনের পরপরই আয়েশা তার স্বামীকে নিয়ে চলে যান সাভারে। সেখান থেকে তারা ৮ ডিসেম্বর চলে যান ঝালকাঠির নলছিটিতে। সেখানে এক আত্মীয়ের বাসায় তারা গা–ঢাকা দেন। কিন্তু পুলিশও নাছোড়বান্দা। পুলিশ দ্রুত অভিযান চালিয়ে ১০ ডিসেম্বর ঝালকাঠির নলছিটি থেকে আয়েশা ও তার স্বামীকে আটক করে।
নেপথ্যের কারণ: পুলিশ তদন্তে নেমে আয়েশাকে গ্রেফতারের পর জানতে পারে, আয়েশা ওই বাসায় কাজে যোগ দেওয়ার পরই কিছু টাকা চুরি করে। বিষয়টি বাসার গৃহকর্তার স্ত্রী লায়লা দেখতে পান। পরদিন তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা বাধে। এক পর্যায়ে আয়েশা আগে থেকে তার কাছে থাকা ছুরি দিয়ে লায়লাকে আঘাত করে। পরে সেই দৃশ্য লায়লার মেয়ে দেখে ফেলে। সে মাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলে তাকেও ছুরিকাঘাত করে আয়েশা। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়।
৭. পুরান ঢাকায় ছাত্রীর বাসায় জবি ছাত্র জোবায়েদ খুন
গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীর পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসেন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় জোবায়েদ বংশাল থানার নূরবক্স লেনের একটি বাসায় প্রাইভেট পড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে নির্মমভাবে খুন হন তিনি।
জোবায়েদ হোসেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ১৫তম ব্যাচের (২০১৯-২০ সেশন) শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনা উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। এ ঘটনার পর জোবায়েদ হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে নানা গল্পের ডালপালা ছড়াতে শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ যে বাসা থেকে জোবায়েদের মরদেহ উদ্ধার করেছিল, সেই বাসার কয়েকজনকে আটক করে। পরে তাদের তথ্যমতে পুলিশ জোবায়েদের প্রেমিকা বার্জিস শাবনাম বর্ষা ও তার প্রেমিক মাহিরকে গ্রেফতার করলে নেপথ্যের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এরপর হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগে মাহিরের বন্ধু ফারদিন আহমেদ আইলানকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ত্রিভুজ প্রেমের বলি জোবায়েদ: তদন্ত করে পরে পুলিশ জানায়, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল ত্রিভুজ প্রেম, যার বলি হন জোবায়েদ। আর হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন প্রেমিকা বর্ষা ও তার প্রেমিক মাহির। তাদের দেওয়া তথ্যমতে উঠে আসে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জোবায়েদ বংশাল থানার নূরবক্স লেনের একটি বাসায় ছাত্রী বর্ষাকে পড়াতে যেতেন। পড়াশোনার সূত্রে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু বর্ষা একই সময়ে জোবায়েদ ও মাহির—দুজনের সঙ্গেই প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ত্রিভুজ প্রেমের জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে নিজেই হত্যার পরিকল্পনা করেন বর্ষা।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর মাহির বিষয়টি নিয়ে বর্ষাকে চাপ দিলে সে জোবায়েদকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর মাহির ও তার বন্ধু ফারদিন আহমেদ আইলান মিলে ছুরি কিনে ১৯ অক্টোবর বর্ষার বাসায় অবস্থান নেয়। বর্ষা তার শিক্ষক জোবায়েদকে ডেকে আনেন। সেখানে সিঁড়ির ঘরে জোবায়েদকে বর্ষার কাছ থেকে সরে যেতে বলা হয়। কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে মাহির জোবায়েদের গলায় ছুরি মেরে পালিয়ে যায়। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
তদন্তে পুলিশ জানায়, বর্ষা কোনো একজনের সম্পর্ক থেকে সরে আসতে পারছিলেন না। তিনি মাহিরকে জানান যে, জোবায়েদকে সরানো না গেলে সে মাহিরের হতে পারবে না। এরপরই তারা হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। পুলিশ আরও জানায়, এই হত্যাকাণ্ডের পুরো পরিকল্পনা ছিল বর্ষার। ঘটনাটি বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার মতোই এক প্রেমঘটিত অপরাধ।
এমআইকে/এআর