জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০৩ পিএম
দেশে মূলধারার যানবাহনের পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলার রিকশা শহর ও গ্রামে, এমনকি রাজধানীতেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব যানের কোনো নিবন্ধন বা লাইসেন্স না থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনেই চলাচল করছে। ফলে দুর্ঘটনাসহ নানা সমস্যা দেখা দিলেও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
দ্রুত ও তুলনামূলক কম খরচে যাতায়াতের সুবিধার কারণে ‘ট্রেসলার’ খ্যাত এসব থ্রি হুইলার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে একদিকে মানুষের পরিবহন ব্যয় কমছে, অন্যদিকে অর্থনীতির গতি বাড়ছে এবং বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকার উৎসে পরিণত হয়েছে এই খাত। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় থ্রি হুইলার সম্পূর্ণ বন্ধ করার পর্যায়ে নেই বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। বরং নীতিমালার মাধ্যমে লাইসেন্স প্রদান করে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণের সময় এসেছে বলে মত দিয়েছে সংস্থাটি।
সোমবার রাজধানীতে সিপিডির আয়োজিত ‘ইন্টিগ্রেটিং ইলেকট্রনিক থ্রি হুইলার ইন্টু ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক: চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, বর্তমানে থ্রি হুইলারে মূলত লিড এসিড ব্যাটারি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং পশুপাখির বাস্তুসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে শুধু পরিবেশগত বিবেচনায় বিষয়টি সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। মানুষের নিরাপত্তা, যাতায়াত সুবিধা, জীবিকা এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে লিড ব্যাটারির পরিবর্তে তুলনামূলক কম ক্ষতিকর লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহার নিশ্চিত করে নীতিমালার আওতায় এসব যানকে আনুষ্ঠানিক পরিবহন ব্যবস্থার অংশ করা প্রয়োজন।
মূল আলোচনা শুরুর আগে ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সাম্প্রতিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও ধারাবাহিক হামলার প্রসঙ্গ তুলে বলেন, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সংবাদপত্র, সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধির প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মবতন্ত্রের মাধ্যমে আঘাতকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, আসন্ন নির্বাচনের পর এসব সহিংসতা আরও বাড়তে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিজস্ব কৌশল গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির প্রোগ্রাম সহযোগী মো. খালিদ মাহমুদ। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে লাখ লাখ যানবাহন চললেও নিবন্ধিত যান মাত্র সাড়ে ২২ হাজার। এর বাইরে থ্রি হুইলার রিকশার সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়েছে এবং এসব যান থেকে সেবা নিচ্ছেন প্রায় ১১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। এত বিপুলসংখ্যক যান ও চালকের কোনো আনুষ্ঠানিক নিবন্ধন বা প্রশিক্ষণ নেই, যা দক্ষতা ও নিরাপত্তা দুটোকেই বাধাগ্রস্ত করছে।
তিনি বলেন, নীতিমালার মাধ্যমে এই খাতকে নিয়ন্ত্রণে আনলে সরকার রাজস্ব পাবে, দুর্ঘটনা ও পরিবেশগত ক্ষতি কমবে এবং সংশ্লিষ্টদের আয় বাড়বে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। তাই থ্রি হুইলারকে নীতিমালার আওতায় এনে গণপরিবহন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং একটি সুসংগঠিত কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ-উজ-জামান খান বলেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত রিকশা কনভার্ট করে ব্যাটারিচালিত করা হচ্ছে। কম খরচে দ্রুত চলাচলের সুবিধায় এসব যানের চাহিদা বাড়ছে। এ বাস্তবতায় থ্রি হুইলার বন্ধ না করে গতি নিয়ন্ত্রণ, লাইসেন্স প্রদান ও চালকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মূল পরিবহন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তিনি দুর্ঘটনা কমাতে থ্রি হুইলারের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে সীমিত রাখার প্রস্তাব দেন।
রিকশা, ব্যাটারি রিকশাভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, দেশে ২০১০ সালে প্রথম চীন থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি করা হয়। ২০১২ সাল থেকেই লাইসেন্স ও সার্ভিস রোডের দাবিতে আন্দোলন চলছে। আদালতের রায় থাকলেও এখনও কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা হয়নি। তিনি দাবি করেন, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ব্যাটারি রিকশার ভূমিকা খুবই সীমিত এবং বর্তমানে এসব যানে লাইট, হাইড্রোলিক ব্রেক ও ইন্ডিকেটরসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। তাই দ্রুত নীতিমালার আওতায় এনে এই খাতকে বৈধতা দেওয়া জরুরি।
টিএই/এআর