নিজস্ব প্রতিবেদক
১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:১২ পিএম
ঢাকার ধানমন্ডি ৩২। একসময় যে স্থাপনাটি ছিল কড়া নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ ও ভয়ভীতির প্রতীক, বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে সেটিই পরিণত হয় মানুষের জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশস্থলে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জড়ো হতে থাকেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। শুরু হয় ধারাবাহিক ভাঙচুর। উচ্চ শব্দ, উত্তেজনাকর স্লোগান ও ভারী যন্ত্রের ব্যবহারে এলাকা পরিণত হয় এক অস্বাভাবিক দৃশ্যপটে।
এলাকায় উপস্থিত সাইফুল ইসলাম বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকেই ধানমন্ডি ৩২ দেখে আসছেন। তার কাছে এটি কখনোই শুধু একটি বাড়ি ছিল না। বরং এটি ছিল এমন একটি জায়গা, যেখানে সাধারণ মানুষ নিজের কথা বলার সাহস পেত না। তার ভাষায়, আজ মানুষ যখন নিজের হাতে সেই স্থাপনা ভাঙছে, তখন অনেকের চোখে রাগ, ক্ষোভের পাশাপাশি মুক্তির অনুভূতিও ফুটে উঠছে। তিনি মনে করেন, কোনো স্থাপনা যদি দীর্ঘদিন অন্যায়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেটি ভেঙে ফেলাও একধরনের সামাজিক শুদ্ধিকরণ। বাইরে থেকে বিশৃঙ্খলা মনে হলেও, এর ভেতরে রয়েছে মানুষের দীর্ঘদিনের জমে থাকা অনুভূতির প্রতিফলন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন এসে জমায়েত হয়। একপর্যায়ে ভাঙচুর আরও তীব্র হয় এবং স্থাপনাটিকে সম্পূর্ণভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
এই ভাঙচুরকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। একাংশ এটিকে ধ্বংসযজ্ঞ হিসেবে দেখলেও, ভাঙচুরে অংশ নেওয়া ও সমর্থনকারী ব্যক্তিরা বলছেন এটি কোনো আকস্মিক সহিংসতা নয়, বরং দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ধানমন্ডি ৩২ একটি স্থাপনার চেয়েও বড় রাজনৈতিক প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, যা ভেঙে দেওয়াকে তারা একটি প্রতীকী ‘সমাপ্তি’ হিসেবে দেখছেন।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, অতীতের নানা সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং ইতিহাসের একমুখী উপস্থাপনাই এই ক্ষোভের মূল কারণ। তারা বলছেন, এই ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটানো হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়।
এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো বিস্তারিত বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিটকে এলাকায় সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে।
আরিফ মাহমুদ নামে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক তরুণ বলেন, ‘অনেকে এটাকে শুধু ভাঙচুর বলছে, কিন্তু আমাদের কাছে এটি প্রতীক ভাঙার লড়াই। ধানমন্ডি ৩২ বছরের পর বছর একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বয়ান চাপিয়ে রাখার কেন্দ্র ছিল। আমাদের প্রজন্ম সেই বয়ানের ভেতর বড় হয়েছে, কিন্তু কথা বলার সুযোগ পায়নি। আজ যে স্থাপনাটি ভাঙা হচ্ছে, সেটি ইট-পাথরের চেয়ে বেশি কিছু ছিল এটি মিথ্যা ক্ষমতার প্রতীক। সেই প্রতীক ভাঙা মানে ভয় ভাঙা। আমরা মনে করি, ইতিহাসের দায় শুধু ভবন রেখে বহন করা যায় না; বরং অন্যায়ের স্মারক সরিয়েই সামনে এগোতে হয়। এই কাজকে সহিংসতা বলা সহজ, কিন্তু যারা ভুক্তভোগী, তাদের কাছে এটি ন্যায়বিচারের এক রূঢ় প্রকাশ।’

ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমি ভাঙচুরকে আনন্দের কিছু মনে করি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো শান্ত ভাষায় দীর্ঘ সময় দাবি জানানো হয়েছে, তাতে কোনো ফল আসেনি। ধানমন্ডি ৩২ একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আধিপত্যের স্মারক হয়ে উঠেছিল। সেই আধিপত্যের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ জমতে জমতে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এই ভাঙচুরকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি রাষ্ট্র, ইতিহাস ও ক্ষমতার কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ। অনেক সময় সমাজে বড় পরিবর্তন আসে অস্বস্তিকর ঘটনার মধ্য দিয়েই। তাই আমি এটিকে অকারণ ধ্বংস নয়, বরং রাজনৈতিক বাস্তবতার কঠিন প্রকাশ হিসেবেই দেখি।’
এম/ক.ম