আব্দুল হাকিম
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৩১ পিএম
মহান বিজয় দিবসের সকাল। শহরের মোড়ে মোড়ে লাল-সবুজের ছোঁয়া। গাড়ির সামনে, বাসার বারান্দায়, মানুষের হাতে হাতে উড়ছে জাতীয় পতাকা। এই গর্বের আবহের মধ্যেই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। তার হাতে ছোট ছোট পতাকার গুচ্ছ। যে পতাকা দেশের অহংকার, সেটাই আজ তার জীবিকার উৎস।
ছেলেটির নাম মাসুম। বয়স পনেরো বা ষোল। স্কুলব্যাগের বদলে তার কাঁধে ঝোলানো প্লাস্টিকের ব্যাগ। ভেতরে ভাঁজ করা পতাকা। সকাল থেকে সে দাঁড়িয়ে আছে ব্যস্ত সড়কের পাশে। কেউ গাড়ির কাচ নামিয়ে পতাকা কেনে, কেউ হেঁটে এসে দরদাম করে নেয়। মাসুমের চোখে তখন তাড়া—আজ বেশি বিক্রি হলে রাতে ভাত জুটবে।
মাসুম জানে আজ বিশেষ দিন। আজ পতাকা বেশি বিক্রি হয়। সে জানে না ১৯৭১ সালের গল্প, জানে না যুদ্ধের ইতিহাস। তবু লাল আর সবুজের মানে সে বুঝে গেছে নিজের মতো করে। এই দুই রং মানে আজ তার কাজ, তার সংসারের খরচ, তার আগামী দিনের খাবার।
পাশ দিয়ে যায় বিজয় র্যালি। মাইকে ভেসে আসে স্বাধীনতার গান। মাসুম একটু থেমে তাকায়। পতাকা উড়তে দেখে তার মুখে এক মুহূর্তের হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু সেই হাসি দীর্ঘ হয় না। আবারও সে ক্রেতার খোঁজে সামনের দিকে আগায়।

একজন মধ্যবয়সী লোক একটি পতাকা কিনে নেয়। দাম মিটিয়ে দিয়ে বলে, পড়াশোনা করিস। সে মাথা নাড়ায়। পড়ে কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর তার কাছে সহজ নয়। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ইচ্ছের চেয়ে বড় বাস্তবতা তার সামনে দাঁড়িয়ে। সকাল পেরিয়ে দুপুর- বাড়ছে রোদের তীব্রতা। পতাকা বিক্রির ভিড় একটু কমে আসে। মাসুম ফুটপাতে বসে পড়ে। ব্যাগের ভেতর তাকিয়ে দেখে কয়টা পতাকা রয়ে গেছে।
সন্ধ্যার আলো নামলে সে বাড়ির পথে হাঁটবে। হয়তো সারাদিনের আয় দিয়ে চাল আর সবজি কেনা হবে। ঘরে ঢুকে সে তার রাখা পতাকাটা দেয়ালে টাঙাবে। হয়তো ঠিকভাবে জানে না স্বাধীনতা কী, কিন্তু সে জানে এই দেশ তার। এই পতাকাই তার পরিচয়।
কথা হয় মাসুমের সঙ্গে। সে জানায়, বিজয় দিবস এলেই তার কাজ একটু বাড়ে। অন্য সময় ছোটখাটো জিনিস বিক্রি করলেও এই দিনে মূল ভরসা জাতীয় পতাকা। মাসুম বলেন, ভাই, আজকে পতাকা বেশি চলে। সকাল থেকে বিক্রি করছি। ছোট কাগজের পতাকা বিক্রি হয় ২০ টাকায়। একটু বড় আর কাপড়ের মান ভালো হলে দাম ৫০ টাকা। মাঝারি সাইজের কাপড়ের পতাকা ৮০ টাকা, আর বড় সাইজেরগুলো ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। সবচেয়ে বড় ও ভালো কাপড়ের পতাকা নিতে চাইলে দিতে হয় ২০০ টাকা।
মাসুম বলেন, শুধু পতাকাই নয়, বিজয় দিবস উপলক্ষে ব্যাজ আর রাবারের ছোট পতাকাও বিক্রি করি। এসবের দাম একেবারে কম—প্রতিটি ১০ টাকা। স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা আর তরুণরা বেশি করে এগুলো কিনে নেয়। অনেকে গাড়িতে ঝোলানোর জন্য রাবার পতাকা নেয়, আবার কেউ শার্টে লাগানোর জন্য ব্যাজ নেয়।
তিনি জানান, পাইকারের কাছ থেকে পতাকা কিনে আনতে হয়। খুব বেশি লাভ থাকে না। তবে আজকের দিনে বিক্রি ভালো হলে সংসারের খরচটা কিছুটা মেটে। আজ যদি ভালো যায়, কালকে আর কাজ না করলেও চলবে (হালকা হাসি)।
বিজয় দিবসের উৎসব শেষ হয়ে যাবে। শহরের রাস্তায় পতাকা কমে আসবে। কিন্তু মাসুমের জীবনের লড়াই থামবে না। যে পতাকা গর্বের প্রতীক, সেটাই কোনো কোনো শিশুর জীবিকার উৎস হয়ে থাকে—এই বাস্তবতা আমাদের বিজয়ের গল্পের পাশেই নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে।
এএইচ/এএস