images

জাতীয়

বিজয় দিবসেও ছুটি নেই শ্রমের চাকার

আব্দুল হাকিম

১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০৩ পিএম

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে শহরজুড়ে উৎসবের আমেজ। সড়কের দুই পাশে লাল-সবুজ পতাকা, মাইকে ভেসে আসে দেশাত্মবোধক গান, মানুষ ছুটে যাচ্ছে স্মরণসভা আর র‍্যালিতে। এই উৎসবের মাঝেই রাস্তায় নেমে পড়েছে শ্রমের চাকা। পেটের দায়ে রিকশার প্যাডেলে পা রেখে একজন শ্রমজীবী মানুষ এগিয়ে চলেছেন—বিজয় দিবসেও যার জন্য ছুটি নেই।

আজ মহান বিজয় দিবস। অন্য অনেকের মতো তার জন্য এটি ছুটির দিন নয়। রিকশার সামনের দণ্ডে ছোট একটি জাতীয় পতাকা বেঁধে সকাল থেকেই রাস্তায়। রিকশাচালকের নাম তার আবদুল কাদের। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। শহরের এই রাস্তাগুলোতেই কেটে গেছে তার জীবনের বড় একটা সময়। রিকশার সামনে বাঁধা ছোট একটি জাতীয় পতাকা দুলছে বাতাসে।

কাদের বলেন, আজকের দিনটা বিশেষ। তাই পতাকাটা লাগিয়েছি। কিন্তু কাজ তো থামানো যাবে না। কাদেরের দিন শুরু হয় ভোরে। অন্য দিনের মতোই আজও তিনি বের হয়েছেন। পার্থক্য শুধু চারপাশের দৃশ্যপটে। আজ যাত্রীদের হাতে ফুল, পতাকা, ব্যানার। কেউ যাচ্ছে শহীদ মিনারে, কেউ বিজয় র‍্যালিতে। আবার কেউ পরিবার নিয়ে বেরিয়েছে ঘুরতে। কাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মানুষ পৌঁছে দিচ্ছেন। উৎসবের আনন্দের মাঝেই চলছে তার জীবিকার লড়াই।

কাদেরের জন্ম স্বাধীনতার কিছু সময় আগে। মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে নেই, তবে শুনেছেন বাবার মুখে। তার বাবা ছিলেন গ্রামে একজন সাধারণ কৃষক। যুদ্ধের সময় খাবার আর খবর পৌঁছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সেই গল্পই কাদেরের কাছে স্বাধীনতার প্রথম পাঠ। রিকশাচালক কাদের বলেন, বাবা বলতেন দেশটা স্বাধীন না হলে মানুষ মানুষ থাকত না।

আজ শহরের বড় সড়ক দিয়ে রিকশা চালাতে গিয়ে নানা রকম যাত্রী ওঠে। যাত্রী নামিয়ে দিয়ে রিকশার সিটে বসে একটু বিশ্রাম নেন কাদের। চোখে পড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যানার, যেখানে লেখা মহান বিজয় দিবস। এই দিনেও তার আয় অনিশ্চিত। কেউ ভাড়া দেয় হাসিমুখে, কেউ দরদাম করে। তবু তিনি রিকশার সামনে বাঁধা পতাকাটা খুলে ফেলেন না। বলেন, এই পতাকাই আমাকে শক্তি দেয়। মনে হয়, এই দেশের জন্য আমার বাবার মতো মানুষ লড়াই করেছে, আমি অন্তত সম্মানটা রাখি।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদ বাড়ে। ঘাম ঝরতে থাকে শরীর বেয়ে। শহরের কোলাহলের মাঝেই তার সংগ্রাম চলতে থাকে। বিজয়ের গল্প তখনো বাজে মাইকে, কিন্তু তার জীবনের গল্প শোনার কেউ নেই। তবু ক্লান্ত মুখে হতাশার ছাপ নেই। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজের জায়গাটুকু ধরে রাখাই তার কাছে বড় বিজয়।

দিন শেষে রিকশা নিয়ে ফিরবেন বস্তির ছোট ঘরে। হয়তো টেলিভিশনে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান দেখবেন, হয়তো দেখবেন না। কিন্তু রিকশার সামনে বাঁধা সেই পতাকাটা যত্ন করে রেখে দেবেন। কারণ এই পতাকা তার কাছে এটি আত্মসম্মান আর টিকে থাকার শক্তি।

স্বাধীনতার এত বছর পরও আবদুল কাদেরদের জীবন সহজ হয়নি। তবু তারা পথ ছাড়েননি। লাল-সবুজের ছায়ায় দাঁড়িয়ে প্রতিদিন প্যাডেল ঘুরিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও তাদের সংগ্রামের চাকা থামে না।

এএইচ/এএস