images

জাতীয়

‘দোয়া করি, নেত্রী যেন হাসিনার বিচার দেখে যেতে পারেন’

আব্দুল হাকিম

০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৩ পিএম

সকাল সাড়ে ৯টা। আলো তখনো পুরোপুরি উঁচুতে ওঠেনি। এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনের রাস্তায় আর ফুটপাতজুড়ে ভিড় ধীরে ধীরে ঘন হতে শুরু করেছে। কিন্তু ভিড়ের আগে যে মানুষটিকে চোখে পড়ে—তিনি বয়সের ভারে নুয়ে পড়া, সাদা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা আশি বছরের এক বৃদ্ধ। হাসপাতালের সামনে ডিভাইডারের ওপর স্থির হয়ে বসে আছেন তিনি। যেন চারপাশের সব কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের নীরব জগতে ডুবে আছেন।

খিলগাঁও এলাকা থেকে সকালেই রওনা হন তিনি। বাসের শব্দ আর রিকশার ধাক্কায় হাঁটা কাঁধ—তবুও গন্তব্য পরিবর্তন হয়নি। বয়সের শেষ প্রহরে এসে যখন মানুষ সাধারণত নাতি-নাতনির হাত ধরে হাঁটে, তিনি তখন ভোরে বেরিয়ে পড়েন কেবল একজন মানুষের খোঁজ নিতে—যিনি হাসপাতালের ভেতরে জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে আছেন—বেগম খালেদা জিয়া।

বৃদ্ধ ব্যক্তির নাম লুৎফর রহমান। বয়স আশির ঘরে। চোখে লালচে ক্লান্তি, তবে দৃষ্টিতে অদ্ভুত দৃঢ়তা। হাসপাতালের ভেতরের প্রতিটি শব্দ যেন তাঁর হৃদয়ে দুলে ওঠে। তিনি বলেন, ‘নেত্রী হাসপাতালে—বাড়িতে বসে থাকতে পারি না। মনে হয় এখানে বসে থাকলে দোয়া কাছেই পৌঁছায়।’
বক্তব্য শেষ হতেই তিনি নিচু স্বরে যোগ করেন— ‘দোয়া করি, নেত্রী (খালেদা জিয়া) যেন হাসিনার বিচার দেখে যেতে পারেন।’

1

তিনি রাজনীতিতে জড়িয়েছেন প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। কোনো পদ চাননি, কোনো সম্মাননা খোঁজেননি। শুধু একটি বিশ্বাসে পথ চলেছেন—রাজনীতি মানে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ‘নেত্রী মানুষের জন্য কাঁদেন—সেজন্যই তাঁর পাশে আছি।’

হাসপাতালের সামনে আজ নিরাপত্তা কঠোর। ব্যারিকেড, চেকপোস্ট, টহলরত পুলিশ। কিন্তু লুৎফর রহমানের মনে এর কোনোটাই উদ্বেগের সৃষ্টি করে না। তিনি নরম গলায় বলেন, ‘ওরা ওদের কাজ করছে। আমি তো কারও সমস্যা করি না। আমি এখানে শুধু দোয়া করতে এসেছি।’

সকলের সঙ্গে কথা বললেও তাঁর চোখ চলে যায় গেটের দিকে। যেন প্রতিটি সেকেন্ডে আশা করছেন ভেতর থেকে কোনো সুসংবাদ বেরিয়ে আসবে। দুপুরের দিকে রোদটা তীব্র হয়। হাসপাতালে আসা অনেকেই ছায়া খুঁজে নেয়। কিন্তু বৃদ্ধটি পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে কপাল মুছে আবার বসে পড়েন। ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণার তাড়াও নেই। মাঝে মাঝে চা আর বিস্কুট দিয়ে কাটিয়ে দেন পুরো দিন।

এক তরুণ কর্মী এসে জিজ্ঞেস করল, ‘চাচা, কিছু খাবেন?’
তিনি ধীরে উত্তর দিলেন, ‘আমি এখানে অন্য কাজে এসেছি বাবা। খাবার পরে হবে।’
তারপর নীরবে যোগ করলেন, ‘মানুষের কষ্টের বিচার হয়। দেরিতে হলেও হয়। আল্লাহ যেন তাকে এতটুকু শক্তি দেন—বিচারটা চোখে দেখে যেতে পারেন।’

2

তিনি জানান, তাঁর পরিবার তাকে থামাতে চেয়েছে বহুবার। এই বয়সে হাসপাতালে যাওয়া নিয়ে তাদের আপত্তি আছে। কিন্তু তিনি তাদের একটাই উত্তর দেন— ‘নেত্রী (খালেদা জিয়া) হাসপাতালে, আমি বাড়িতে বসে থাকব? শরীর আল্লাহর হাতে। তিনি আমাকে ভালোভাবে নিয়ে যাবেন।’

এরপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগে ভিড় একটু কমে আসে। লুৎফর রহমান ধীরে উঠে দাঁড়ান। তাঁর শরীর ভারী, কিন্তু দৃষ্টি অদ্ভুতভাবে দৃঢ়। যাওয়ার আগে আবার তিনি হাসপাতালের গেটের দিকে তাকান। যেন চোখে চোখে কাউকে পাহারা দিচ্ছেন।

এএইচ/এআর