আব্দুল কাইয়ুম
০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:২২ পিএম
* সাপ্তাহিক ও মাসিক হারে কিস্তিতে নিতেন ঘুষের টাকা
* বিএনপি নেতা হলে তুলে নিয়ে দিতেন ক্রসফায়ার
রাজধানীর পল্লবী থানার সাবেক ওসি দাদন ফকির কিস্তিতে আদায় করা ঘুষের টাকা এখন ভুক্তভোগীদের খুঁজে খুঁজে ফেরত দিচ্ছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশে পট পরিবর্তনের পরই তিনি টাকা ফেরত দেওয়া শুরু করেছেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মামলা ও হয়রানির হুমকি দিয়ে বহুদিন ধরে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ আদায়ের অভিযোগ ছিল পুলিশের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এসব অর্থেই তিনি মিরপুরে বহুতল ভবনসহ বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী, স্থানীয় ও বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওসির দায়িত্বে থাকাকালে অনেককে থানায় ডেকে নেওয়া হতো। পরে সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডে জড়িত দেখিয়ে গ্রেফতার বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হতো। এরপর তাদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হতো। যারা টাকা একসঙ্গে দিতে পারতেন না, তাদের সামর্থ্য দেখে সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পরপর কিংবা প্রতি মাসে একটা কিস্তির সিস্টেম করে দিতেন। সে অনুযায়ী টাকা আদায় করতেন। এসব টাকা দিয়ে দাদন ফকির মিরপুরের ইস্টার্ন হাউজিংয়ে ৫ তলা বাড়ি, স্বপ্ননগর প্রজেক্টে দুটি বহুতল ভবন গড়ে তুলেছেন।
যেসব ভুক্তভোগীর টাকা ফেরত দিয়েছেন
পল্লবী এলাকার বাসিন্দা কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি ইয়াসিন আলী বলেন, ‘২০১৬ সালে আমাকে ধরে এনে ক্রসফায়ার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সাবেক ওসি দাদন ফকির। তখন আমাকে চোখ বেঁধে ক্রসফায়ার দেওয়ার জন্য সাগুপ্তা এলাকায় নিয়ে যাওয়া। সেখানে গিয়ে চোখ খুলে দিয়ে একটা খালি জায়গায় ছেড়ে দিয়ে আমাকে দৌড়াতে বলে। সবাই আমার দিকে অস্ত্র তাক করা। আমি তখন আমার সন্তানদের চেহারা মনে করছিলাম আর আল্লাহকে বলতে থাকি, আল্লাহ তুমি আমার সন্তানদের দেইখা রাইখো। তখন আল্লাহর কি রহমত, আমি না দৌড় দেওয়ায় তারা আমাকে আবার চোখ বাঁধে। তখন আমি বুঝতে পারি এখন আর আমাকে তারা ক্রসফায়ার দেবে না। তারা আমাকে ওইখান থেকে গাড়িতে তুলে পল্লবী থানায় নিয়ে যায়। ওই সময় আমাকে ৬-৭ তলায় তুলে একটা রুমে নিয়ে আসে। সেখানে আমাকে বন্দি রেখে দুই দিন পর মিডিয়ার সামনে হাজির করে। এরপর ভয় দেখিয়ে আমার থেকে ১২ লাখ টাকা নেয়। পট পরিবর্তনের পর সে আমাকে ৮ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে।’
আরও পড়ুন: এবার ডিএমপির ৫০ থানার ওসিকে একযোগে বদলি
ইয়াসিন আলী আরও বলেন, ‘আমি টাকা ফেরত চাই না। আমি চাই তার বিচার হোক। সে যেভাবে স্বৈরাচার সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন লোককে বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করেছে, মামলার ভয় দেখিয়ে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। আমি সেই ওসির বিচার চাই।’
মোয়াজ্জেম হোসেন নামে আরেক ভুক্তভোগী জানান, পট পরিবর্তনের পর পল্লবী থানার সাবেক ওসি দাদন ফকির আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমার থেকে নেওয়া ৭ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি করি বলে দাদন ফকির ২০১৬ সালে আমাকে বিনা কারণে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। তখন আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা দেয়। অনেক মামলা দেবে বলে চাপে ফেলে আমার থেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করে। সরকার পরিবর্তনের পর সে ভয়ে আমাকে অন্য লোকের মাধ্যমে ৭ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে। বাকি টাকা দেবে বলে এখনো ঘুরাচ্ছে।’
আলতাফ মোল্লা নামে আরেক বিএনপি নেতা বলেন, ‘ওই সময় আমাদেরকে গ্রেফতার করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হতো। এরপর অনেক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতো। আমরা যারা একসঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে পারতাম না, তাদেরকে কিস্তির সিস্টেম করে দিয়ে প্রতি সপ্তাহে বা দুই সপ্তাহে অথবা মাসে টাকা পরিশোধ করার সিস্টেম করে টাকা আদায় করতো।’

বিএনপি নেতারা ছাড়াও আলতাফ মোল্লা, মো. লালনসহ আরও বেশ কয়েকজন নেতাকে মামলা ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে আদায় করা টাকা ফেরত দেওয়া শুরু করেছেন পল্লবীর সাবেক ওসি দাদন ফকির।
সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের এভাবে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের ঘটনায় পুরো পল্লবী এলাকায় জনমনে উদ্বেগ উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছিল। সাধারণ মানুষ বলছেন, যদি একজন ওসি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় মানুষকে মামলা ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করে, তাহলে মানবাধিকার কোথায়। এমন পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে দাদন ফকিরের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারে কল দিয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এছাড়াও তার গড়ে তোলা মিরপুরের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের সি ব্লকের ১১১ নম্বর বাড়িতে গিয়েও তার কোনো বক্তব্য নেওয়া যায়নি। এসব বিষয়ে কোন কথা বলবেন না বলে জানান বাড়ির দারোয়ান।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী ড. মো. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের পুলিশ কর্মকর্তাদের বিধিবিধান অনুযায়ী, মানুষকে হয়রানি করা বা জোরপূর্বক কোনো কিছু আদায় করা বা ভয়ভীতি দেখিয়ে কোনো সুযোগ সুবিধা নেওয়া সেটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সেটা যেকোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা হোন না কেন তার জন্য পুলিশের বিভাগীয় পর্যায়ের শাস্তি এবং দেশের প্রচলিত আইনে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে আমরা দেখেছি, পুলিশ তাদের চাকরির বিধিবিধান ও নৈতিকতা দূরে রেখে সরকারের ক্ষমতায় গোটা কয়েক পুলিশ সদস্য গড়ে ওঠেছে। সেখানে দেখা গেছে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা সরকারের পরিচয়ে যারা নিজেদের পরিচিত করতে পেরেছেন, তারা কোনো আইনকে তোয়াক্কা করেননি।
‘তারা সরকারের বিভাগীয় আইন কিংবা দেশের প্রচলিত আইনকে তোয়াক্কা করেননি। তারা সরকারের ক্ষমতায় ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, ব্যবসায়ী চাঁদা না দিলে তাকে ব্যবসা করতে না দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে ওসি টাকা ফেরত দিয়েছেন, তিনি আত্মশুদ্ধির জায়গা থেকে নয় বরং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হওয়ার পর ভয়ে টাকা ফেরত দিচ্ছেন। তবে, আইন অনুযায়ী টাকা ফেরত দিলেও অপরাধ থেকে তার পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। যে অপরাধ করা হয়েছে, সেজন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে ভুক্তভোগীদের মতামত নিয়ে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে পুলিশ বাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করে বাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করে এমন কাজ করার কেউ সাহস পাবে না। সরকার উদ্যোগ নিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
একেএস/এআর/এমআর