images

জাতীয়

‘ডাল-ভাতে’ অনিয়ম ও অফিসারদের নিষ্ক্রিয়তা বিডিআর বিদ্রোহে ভূমিকা রাখে

বিশেষ প্রতিনিধি

০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:১৫ পিএম

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিজিবির (আগের নাম বিডিআর) সদর দফতরে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আগে বাহিনীর ভেতরে অস্থিতিশীলতা, প্রশাসনিক শৈথিল্য, ক্ষমতার অপব্যবহার ও নানা অসন্তোষ জমে উঠছিল বলে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সাড়ে তিন হাজারের বেশি পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্যও উঠে এসেছে।

গত রোববার (৩০ নভেম্বর) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিশন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কমান্ড কার্যক্রমে অফিসারদের সম্পৃক্ততা শূন্যের কোঠায় ছিল। এডি ও ডিএডিদের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার ও অযাচিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ডাল-ভাত কর্মসূচি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিধি লঙ্ঘন এবং অনৈতিক নীতিমালা সরাসরি সৈনিকদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। অপরদিকে কিছু অফিসার ক্ষমতা ও পদ ব্যবহার করে ডাল-ভাত কর্মসূচির আড়ালে ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়েছেন। তৎকালীন ডিজির স্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডিজিএফআই কর্তৃক পরিচালিত তদন্ত কার্যক্রম সাবেক ডিজি বিডিআরের হস্তক্ষেপে স্থগিত করা হয়।

ডিজির স্টাফ অফিসারের অস্বাভাবিক ক্ষমতা

প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজির প্রশ্রয়ে তার স্টাফ অফিসারের (মেজর মাহবুব) এখতিয়ার-বহির্ভূত কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ সকল ক্ষেত্রে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। অবসরের পূর্বে এবং মানবিক কারণে অফিসারদের বিডিআরে প্রেষণে নিয়োগ ইত্যাদি কারণে বিডিআর সদর দফতরের কমান্ড কার্যক্রমে তারা পরিপূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেননি। ফলে বিদ্রোহীরা নির্বিঘ্নে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নেয়। অফিসারদের নিষ্ক্রিয়তা বিদ্রোহের প্রস্তুতিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পিলখানার ভেতরে দিনেদুপুরে রাজনৈতিক এবং অজ্ঞাত বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত মিটিং, ব্যাটালিয়নের যানবাহন নিয়ে পিলখানার বাইরে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর জন্য বিডিআরের পোশাক তৈরি, ভান্ডার থেকে বিডিআরের পোশাকের থান কাপড় বাইরে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে পিলখানার কোনো অফিসার কিছুই জানতে পারেনি এবং জানার চেষ্টা করেছিল মর্মে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়া সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতির জন্য ঘটনাপূর্ব সময়ে দীর্ঘ দিন থেকে নিয়মিতভাবে গ্রেনেড প্রাইম করে ম্যাগাজিনে বাক্সগুলি নিচের দিকে সাজানো, খাগড়াছড়িতে বিডিআর হেডকোয়ার্টার্স লেখা গুলির বাক্স পুকুর থেকে উদ্ধার ইত্যাদি বিষয় প্রমাণ করে পিলখানায় অফিসারদের কমান্ড কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তা এবং উদাসীনতা বিদ্রোহের প্রস্তুতিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদারকি কার্যত অনুপস্থিত ছিল

বিডিআরের ওপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রশাসনিক তদারকি ছিল না। এমনকি তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব রাইফেলস সপ্তাহ ২০০৯ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। ডাল ভাত কর্মসূচি নিয়ে অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ ছিল যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদারকি করেনি। ক্রয় প্রক্রিয়া এবং ব্যয়িত সরকারি অর্থের উপরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক কোনো অডিট করা হয়নি।

অপারেশন ডালভাত ও বিডিআর শপ অনিয়মে ক্ষুব্ধ হয় সৈনিকরা

২০০৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলা অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচির ক্রয় প্রক্রিয়ায় ভয়াবহ অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিশন।

bdr1_ডাল-ভাত প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা, বাজার পরিস্থিতি তদারকি ও সুব্যবস্থাপনার অধীনে আনয়ন এবং সর্বোপরি ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে ২০০৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিডিআরের তত্ত্বাবধানে ‘অপারেশন ডালভাত’ কর্মসূচি পরিচালিত হয় যেখানে ক্রয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেছেন মূলত মেজর জেনারেল শাকিল এবং কর্নেল মুজিব।

প্রতিবেদনে ডাল-ভাত প্রকল্পের নানা অনিয়ম তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো-

(১) ডাল-ভাত প্রকল্পের ক্রয়: মালয়েশিয়া থেকে আমদানিকৃত নিম্নমানের ভোজ্য তেল উচ্চ দামে বিক্রি করা, চীন থেকে আমদানি করা নিম্নমানের দুধ সৈনিকদের মধ্যে বিতরণ করা বিডিআর সদস্যদের ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই প্রেক্ষিতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পণ্য ক্রয় করা হয়েছিল কি-না তা যাচাইয়ের জন্য কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী বিজিবি কর্তৃক প্রয়োজনীয় দলিলাদি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।

(২)   ডাল-ভাত প্রকল্পে দোকান বরাদ্দ: ‘নির্মল উদ্যোগের’ ব্যানারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সর্বসাধারণের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার লক্ষ্যে সারাদেশে ১০০টি বিডিআর শপ চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শপগুলো পরিচালনার দায়িত্ব লে. কর্নেল কামাল আহমেদ (অব.) এর ওপর ন্যস্ত করা হয় (যিনি পত্রিকায় প্রদত্ত বিজ্ঞাপন ছাড়া সরাসরি আবেদনের প্রেক্ষিতে ‘নির্মল উদ্যোগের’ পরিচালনার দায়িত্ব পান)। এছাড়াও বিডিআর কল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে যে ১৮টি দোকান চালু ছিল যার মালিকানা ও লাভের অর্থ সম্পর্কে বিডিআর সদস্যদের স্বচ্ছ ধারণা না দেওয়ার বিষয়টিও তাদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে ধারণা করা হয়।

এই প্রেক্ষিতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দোকান বরাদ্দ করা হয়েছিল কি-না তা যাচাইয়ের জন্য কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী বিজিবি কর্তৃক প্রয়োজনীয় দলিলাদি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।

মনিটরিংহীনতায় ডাল-ভাত প্রকল্পে অনিয়ম

প্রাথমিক পর্যায়ে ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে ডালভাত কার্যক্রমে বিডিআর কর্তৃক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আনুমানিক ২০ কোটি টাকার পণ্য সামগ্রী ক্রয়ের মাধ্যমে ওই বছরের ১ জুলাই পর্যন্ত অপারেশন ডালভাত পরিচালনা করা হয়। পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক প্রদানকৃত আনুমানিক ৩৫৪ কোটি টাকার পণ্য সামগ্রী ক্রয়ের মাধ্যমে এ অপারেশন পরিচালনা করা হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধকল্পে বিডিআর কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রম দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া জাগালেও পূর্ব অভিজ্ঞতা ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং সুষ্ঠু মনিটরিংয়ের অভাবে বিভিন্ন অনিয়মের সৃষ্টি হয়। সেনাবাহিনী খবর পেয়েছিল যে অপারেশন ডালভাত এর যে কার্যক্রম ছিল সেটি নিয়ে বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। বিডিআর জওয়ানদের এ ধরনের কাজে সম্পৃক্ত করা কোনো ভালো উদাহরণও ছিল না।

সৈনিকদের দৈনিক ভাতা নিয়েও বঞ্চনার অভিযোগ

২৪ রাইফেল ব্যাটালিয়ন অপারেশন ডালভাতের অংশ হিসাবে ঢাকা শহরে ৫০টি আউটলেটে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি বিক্রি করছিল। এই কাজে লোয়ার লেভেলে বেশ কিছু ‘মিসঅ্যাপ্রোপ্রিয়েশন’ হয়। যেমন এক কেজি ডালের জায়গায় ১০/২০ গ্রাম কম দেওয়া হতো। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের আগস্টে সৈনিকদের জন্য সরকার থেকে কিছু ‘ডেইলি এলাউন্স’ (ডিএ) বরাদ্দ হয়। সকল সৈনিক তাদের নিজেদের মতো করে ডেইলি এলাউন্স পাওয়ার একটি হিসাব করে। কিন্তু সরকারি ভাতার ব্যাপারে একটি নিয়ম আছে যে, প্রথম কিছুদিন ‘ফুল রেটে’ পাওয়া যাবে এবং পরবর্তীতে দিনানুপাতিক হারে ডিএ কমে যাবে। ফলে তাদের হিসাব অনুযায়ী তারা কিছু কম টাকা পায়। এই কম পাওয়াটাকে তারা বঞ্চনা হিসেবে গণ্য করেছিল।

এছাড়া ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০৯ সালের ৩য় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে টাকা যথাসময়ে না পাওয়ায় তা বিডিআর সৈনিকদের প্রদান করা সম্ভব হয়নি। সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনের ডিএ যথাসময়ে প্রদান না কারার কারণসমূহও সৈনিকদের যথাযথভাবে অবহিত করা হয়নি।

বিডিআর সদস্যদের ছুটি

২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দরবারে বিডিআর সদস্যরা সেনাসদস্যদের ন্যায় ২ মাস বাৎসরিক ছুটির দাবি উত্থাপন করে। সীমান্ত রক্ষা, চাকরির অত্যাবশ্যকীয়তা এবং বিডিআর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক পূর্বের মতো ০১ মাস বাৎসরিক ছুটি বহাল রাখা হয়।

বিডিআর স্কুল

২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে পিলখানার অভ্যন্তরে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস্ পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ এবং বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ রাইফেলস্ কলেজের সাথে পরিচালিত ইংলিশ সেকশন সমূহকে একত্রিত করে ন্যাশনাল কারিকুলামের একটি ইংলিশ ভার্সন স্কুল পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ২৪ নভেম্বর এবং ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর নোটসিট অনুযায়ী নতুন স্কুলটির নামকরণ করা হয় বীর উত্তম ফজলুর রহমান স্কুল ও কলেজ।

২০০৮ সালের ২ নভেম্বর একটি নোটসিট অনুযায়ী উক্ত স্কুলের শিক্ষক নির্বাচনের জন্য মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সভাপতি হিসেবে নির্বাচন করা হয় উপদেষ্টা, ইংরেজি মাধ্যমকে। নোটসিট এর উপরে উপদেষ্টা হিসেবে সই করেছেন নাজনীন আহমেদ। ১৮ জানুয়ারি ২০০৯ এ প্রেরিত বীর উত্তম ফজলুর রহমান স্কুল ও কলেজের একজন শিক্ষককে নিয়োগ পত্রেও তিনি সই করেছেন।

bdr3_
প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয় তদন্ত প্রতিবেদন।

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর ২০০৯ সালের ১৮ আগস্ট বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস্ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভার্নিং বডির ৫৭ তম সভায় বীর উত্তম ফজলুর রহমান স্কুলটিকে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ ও কলেজের সঙ্গে একীভূত করা হয়। ফেব্রুয়ারি ২০১০ অনুষ্ঠিত বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস্ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কালেজের ৫৯তম সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যমে বিডিআর সদস্যদের জন্য ভর্তির সময় মোট প্রদেয় ১২,০০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২,৭০০ টাকা করা হয়।

অন্যান্য বিষয়ে অনিয়ম

ডালভাতের সিস্টেম লসের (ওজনে কম পাওয়া গেলে তার দায় বিডিআর সৈনিকদের উপর দেয়া হতো, জাল নোট দিয়ে ক্রেতা মালামাল ক্রয় করলে সেই টাকা সংশ্লিষ্ট বিডিআর সদস্যদের কাছ থেকে আদায় করা হতো।

অস্বাভাবিক হারে সাজা: ডালভাত কর্মসূচিতে কর্মরত বিডিআর সদস্যদের বিভিন্ন অনিয়মের কারণে অস্বাভাবিক হারে সাজা দেওয়া হয় যা সৈনিকদের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল।

বিডিআর প্যারেড ২০০৯ সালে লালকালি যুক্ত জওয়ানদের অংশ গ্রহণ কিংবা দর্শক হিসেবে উপভোগ করতে পারবে না মর্মে যে সিদ্ধান্ত হয় তাও বিডিআর সদস্যদের মাঝে অসন্তোষের সৃষ্টি করে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

এমআর