মাহফুজুর রহমান
২৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:৪০ পিএম
কড়াইল বস্তির অগ্নিকাণ্ডে শুধু ঘর নয়, শিশুদের ছোট ছোট স্বপ্নও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ডে শত শত ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ার খবরের ভিড়ে হারিয়ে গেছে শিশুদের ছোট ছোট স্বপ্ন ও আনন্দের গল্প। যে আগুনে তাদের বাসস্থান ভস্মীভূত হয়েছে, সেই আগুনেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাদের খেলনা, সাইকেল, স্কুলব্যাগ এবং অবসরের সঙ্গী। যা কেবল জিনিসপত্র নয়, ছিল তাদের প্রতিদিনের হাসি, খেলাধুলা এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুননের মাধ্যম।
এই শিশুদের মধ্যে সাত বছর বয়সী রাফির গল্প সবচেয়ে মর্মস্পর্শী। আগুন নেভার পর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সে তার প্রিয় লাল সাইকেলটি চিনতে পারেনি, যখন তার বাবা একটি পোড়া ও বাঁকা লোহার ফ্রেম হাতে তুলে দিলেন। সাইকেলটির লাল রং পুড়ে কালো হয়ে গেছে, টায়ার ও হ্যান্ডেলের রবার গলে ঝুলে পড়েছে।

সাইকেলের লাল রং পুড়ে কালো, টায়ার গলে যাওয়া, হ্যান্ডেলের রবার গলে পড়া—সব মিলিয়ে এটি আর কোনোভাবেই সাইকেল নয়, কেবল স্মৃতি।
রাফির মা জানান, ঘর ও অন্যান্য জিনিসপত্র হারানোর চেয়েও রাফি তার সাইকেলটির জন্য বেশি কেঁদেছে। রাতে রাফি মাকে জিজ্ঞেস করেছে, মা, আমার সাইকেল ঠিক হবে কি। মা-বাবা তাকে সান্ত্বনা দিলেও নতুন একটি সাইকেল কেনার সামর্থ্য তাদের এখন নেই। তবুও রাফি আশা ছাড়েনি।
রাফির আশা মরে যায়নি। সাইকেলের পোড়া ফ্রেমটি তুলে নিয়ে সে বলেছে, আমি আবার চালাবো, যখন নতুনটা পাবো। তার সেই আশায় কড়াইলের ছাইয়ের ভেতরেও শিশুস্বপ্নের আলো এখনো ক্ষীণভাবে জ্বলছে।
রাফির মতো আরও শিশুরা হারিয়েছে নিজেদের প্রিয় জিনিস। নয় বছরের নুসরাত জানিয়েছে, তার স্কুলব্যাগ আর আঁকার খাতা সবই পুড়ে গেছে। আঁকা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় ভালোবাসা। আমি বড় হয়ে আঁকিয়ে হতে চাই বলেও সে এখন খাতা-রঙহীন এক বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে।
এগারো বছরের হাবিবের ফুটবল আগুনে গলে গেছে। মাঠে দৌড়ানোর সেই উত্তেজনা এখন তার কাছে দূরের স্মৃতি। সে জানিয়েছে, ফুটবলটাই ছিল তার সারাদিনের অপেক্ষার কারণ। বন্ধুরা এখনো খেলার কথা বললেও সে আর তার বলটি নিয়ে যেতে পারবে না।

আরো আছে আট বছরের মীম। তার পুতুল-ঘর, ছোট রান্নার সেট এবং খেলনা বাসন—সব মিলিয়ে সে প্রতিদিন নিজের মতো করে এক বাড়ি বানাত। আগুনে সেগুলো পুড়ে যাওয়ার পর সে এখন মায়ের কাছে শুধু জিজ্ঞেস করে, আমার পুতুলটা কোথায় গেল। মা উত্তর দিতে পারেন না, শুধু চুপ করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
বস্তির বড়দের মতো শিশুরাও চলছে অদৃশ্য এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, স্বপ্ন হারানোর লড়াই। তাদের খেলনা ফিরিয়ে আনা হয়তো কঠিন, কিন্তু চোখের কোণে জমে থাকা সেই শূন্যতা বলে দেয়, আগুন শুধু ঘর ভেঙে দেয়নি; শিশুদের আনন্দ, নিরাপত্তা এবং ছোট্ট কল্পনার জগৎকেও ছিন্ন করে দিয়েছে। তবুও তারা আশা ধরে রেখেছে কখনো আবার নতুন খেলনা পাবে, আবার সাইকেল চালাবে, আবার মাঠে খেলাধুলায় মেতে উঠবে।
এই অগ্নিকাণ্ড শুধু ঘরবাড়িই পুড়িয়ে দেয়নি, পুড়িয়ে দিয়েছে একটি প্রজন্মের শৈশবের নিরাপত্তা, আনন্দ এবং স্বপ্ন দেখার জায়গা। বড়দের মতো করেই এই শিশুরাও এক অদৃশ্য যুদ্ধে লড়ছে স্বপ্ন হারানোর যুদ্ধ। তাদের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, আগুন শুধু ঘরই নয়, তাদের কল্পনার রাজ্যকেও ছিন্নভিন্ন করেছে। তবুও তাদের মনের গভীরে জ্বলছে একটু আশা—নতুন সাইকেল, নতুন ফুটবল, নতুন আঁকার খাতা পাওয়ার এবং আবার খেলাধুলায় মেতে ওঠার।
এম/এআর