মোস্তফা ইমরুল কায়েস
২৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:২৮ পিএম
তপ্ত রোদে বসে আছেন সাফিয়া বেগম। স্বামী নেই। দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন কড়াইল বস্তিতে। অন্যের বাসায় কাজ করে সংসার চালান। মাত্র দুই দিন আগেও সাফিয়ার ঘর ছিল, স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এখন কোনোটাই নেই। গত দুই দিন ধরে তিনি ও তাঁর সন্তানরা অন্যের দেয়া খাবার খেয়ে বেঁচে আছেন।
বুধবার দুপুরের রোদের মধ্যে পোড়া ঘরের ওপর দাঁড়িয়ে অপলক চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ডেকে উঠতেই চমকে গেলেন।
জানতে চাইলাম, কয়টি ঘর পুড়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি কতটা। প্রশ্ন শুনেই তাঁর গলা শুকিয়ে এল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, বাবারে, আমার একটা ঘর আছিলো। ঘরে অনেক কিছুই ছিল। সব শেষ হয়ে গেল। কষ্ট করে টিপি, ফ্যান, হাড়িপাতিলসহ অনেক কিছুই করেছিলাম। সব পুইড়া গেছে। কিছুই বাঁচাইতে পারি নাই। খালি গায়ে দৌড় দিছি।
অন্যদিকে পোড়া ঘরে দাঁড়িয়ে নাতনিকে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছিলেন শেরপুরের জোবেদা খাতুন। দুই দশক আগে এই বস্তিতে এসেছিলেন। এক মেয়ে ও দুই ছেলেকে এখানেই বড় করেছেন। এক ছেলে চাকরি করেন, আরেক ছেলে পড়াশোনা করছে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তাই সে থাকে অন্যত্র। শাশুড়ির ঘর পুড়েছে শুনে জামাই ছোট মেয়েকে নিয়ে ছুটে এসেছে। পোড়া ঘরের পাশে পড়ে আছে দুটি ফ্যানের কয়েল। সেগুলো নাড়াচাড়া করছিল এক লোক।
জোবেদাকে একই প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, তিনবার ঘর পুড়লে আর কিছু কি থাকে রে বাবা।
সাফিয়া ও জোবেদার এই বস্তিতে কোনো নিজস্ব ঘর নেই। তারা গত দুই দশক ধরে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়ায় থাকেন। এই সময়ে তাদের তিনবার ঘর পুড়েছে। তারা নিঃস্ব হয়েছেন। কিন্তু তাদের ঘর ভাড়া দিয়ে আরেক পক্ষ হয়েছে লাভবান। তাদের ভাষায় এই পক্ষই বাড়িওয়ালা।
ভুক্তভোগী বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেউ দুই দশক, কেউ তিন দশক ধরে এখানে থাকছেন। বস্তির ৮০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। মাত্র ২০ শতাংশ বাড়িওয়ালা, তারাও জমির প্রকৃত মালিক নন।
জানা গেল, জমিটি মূলত সরকারি জমির ওপর গড়ে ওঠা বস্তি। প্রায় ৫০ একর জায়গা নিয়ে আশির দশকে এর সৃষ্টি। প্রথমে বন্যায় ভাসমান লোকজনকে থাকার জায়গা হিসেবে অনুমতি দেয়া হয়েছিল। পরে বিভিন্ন সরকারের আমলে রাজনৈতিক পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি জায়গা দখল করে ঘর নির্মাণ শুরু করেন এবং ভাড়া দেন।
রুবেল মিয়া পোড়া ঘর থেকে লোহার অংশ খুঁজছিলেন। দুই দিন আগেও তাঁর দুটি দোকান ও ২০টি ঘর ছিল। ঘর ভাড়া দিয়ে ও দোকান চালিয়ে ভালোই চলছিল তাঁর সংসার। এখন সব শেষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বস্তিতে যারা ঘর ভাড়া দিতেন, তারা প্রত্যেকেই লাখপতি। অনেকের ব্যাংক ব্যালেন্সও রয়েছে। যদিও তারা সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত হন, কিন্তু তাদের টাকাপয়সা ব্যাংকেই থাকে। তার ওপর ঘর পুড়লেই তারা ব্যাংক ঋণ পান।
এই ঋণ তারা আদৌ শোধ করেন কি না, জানতে চাইলে শরীফ নামে এক যুবক বলেন, বস্তিতে ৮০ শতাংশই ভাসমান মানুষ। অধিকাংশই রিকশাচালক, গৃহকর্মী, হোটেল বয়, কামলা বা গার্মেন্টস কর্মী। তাই তারা ভাড়ায় থাকেন। প্রতি বছরই নতুন ঘর ওঠে। যার যার মতো জায়গা দখল করে। বাড়ির মালিকরা আগুন লাগলেই ব্যাংক ঋণ পান, আর আগুনে ঘর পুড়লে সে ঋণ আর শোধ করতেও হয় না।
তিনি আরও জানান, কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেন যাতে ঋণ শোধ করতে না হয়। অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে এবার সে ধরনের কিছু হয়েছে কি না, তা তারা নিশ্চিত নন। তবে সিলিন্ডার থেকেই আগুন লেগেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানাচ্ছেন।
জানা গেল, যে বাড়ি থেকে আগুনের সূত্রপাত, তার মালিক মিন্টু। তাঁর একারই ২০টি ঘর ছিল। নিচতলা ও দোতলা মিলিয়ে তিনি ঘর ভাড়া দিতেন। সঙ্গে নাস্তার হোটেল চালাতেন। সেই হোটেল থেকেই আগুনের সূত্রপাত। তার পাশেই আটটি নতুন ইটের ঘর তোলা হচ্ছিল, হয়তো কিছুদিন পর সেগুলোও ভাড়া দিতেন।
মিন্টুর পাশেই থাকেন মাসুদ নামের আরেক বাড়িওয়ালা। তাঁরও প্রায় ২৫টি ঘর রয়েছে। ভাড়াটিয়া সাফিয়া বললেন, ঘটনার পর মাসুদ পালিয়ে গেছে। একবারও খোঁজ নেয়নি।
বস্তিবাসীদের অভিযোগ, তারা প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হন, কিন্তু বাড়িওয়ালাদের কিছুই হয় না। তারা ভাড়া তুলে ব্যাংকে রাখেন, সেই টাকায় চলেও ভালো। সব চাপ গিয়ে পড়ে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর।
গত দুই দিনে বস্তির ভুক্তভোগীদের পানি আর খিচুড়ি ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো সহযোগিতা দিতে দেখা যায়নি কোনো সংস্থা বা রাজনৈতিক দলকে। খোলা আকাশের নিচে দিন কাটছে তাদের, চেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
এমআইকে/এআর