ঢাকা মেইল ডেস্ক
২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০৬ এএম
রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় অল্প সময়ের ব্যবধানে একের পর এক ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনি অনুভূত হওয়ায় জনজীবনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আঘাত হানা চারটি ভূমিকম্পের মধ্যে তিনটির উৎপত্তিস্থল ঢাকার কাছে নরসিংদীর বিভিন্ন উপজেলায়। আর একটির উৎপত্তিস্থল রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়। এই অস্বাভাবিক ‘সিরিজ ভূমিকম্প’ কী ইঙ্গিত দিচ্ছে তা নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। কারো মতে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ইঙ্গিত মিলছে, আবার কারো মতে পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে। তবে ভূতত্ত্ববিদ ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকাকে সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করছেন।
সিরিজ চার ভূমিকম্প কখন কোথায়
আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল হলো ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে নরসিংদীর জেলার মাধবদী উপজেলায় মাটির প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে। এটিকে বাংলাদেশে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হিসেবে বর্ণনা করেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগও।
এর তীব্র ঝাঁকুনিতে দেশজুড়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল এবং বিভিন্ন জায়গায় মারা গেছে অন্তত দশ জন।
আবহাওয়া বিভাগ প্রথমে এটিকে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার উল্লেখ করলেও পরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক সংস্থা ইউএসজিএসকে উদ্ধৃত করে ভূমিকম্পটি ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ছিলো বলে ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছে।
আরও পড়ুন: ঢাকায় বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা কতটুকু?
শনিবার সকালে আবারও যে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩, যার উৎপত্তিস্থল নরসিংদী জেলারই পলাশ উপজেলা।
ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, এর একটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদী আর অন্যটির উৎপত্তিস্থল ঢাকার বাড্ডা।
এর মধ্যে বাড্ডার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে, যার মাত্রা ছিলো রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭।
আর এক সেকেন্ডের মধ্যেই আরেকটি ভূকম্পন অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল নরসিংদী। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ছিলো ৪ দশমিক ৩।
কী ইঙ্গিত দিচ্ছে এসব ভূমিকম্প
বিশেষজ্ঞদের মতে, টেকটনিক প্লেটে বাংলাদেশের যে অবস্থান তাতে দুটো প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে- পশ্চিমে ইন্ডিয়ান প্লেট আর পূর্ব দিকে বার্মা প্লেট। আর বাংলাদেশের উত্তরদিকে আছে ইউরেশিয়ান প্লেট।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেছিলেন, ভারতীয় প্লেটটি ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বার্মা প্লেটের নিচে অর্থাৎ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। আর এই তলিয়ে যাওয়ার কারণে একটা সাবডাকশান জোনের তৈরি হয়েছে।

‘এই জোনের ব্যাপ্তি সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চল এর মধ্যে পড়েছে। এখানে বিভিন্ন সেগমেন্ট আছে। আমাদের এই সেগমেন্টে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তি জমা হয়ে আছে। এটা বের হতেই হবে।’
তার মতে, ‘এখানে প্লেট লকড হয়ে ছিল। এর অতি সামান্য ক্ষুদ্রাংশ খুলল বলেই শুক্রবারের ভূমিকম্প হয়েছে। এটিই ধারণা দেয় যে সামনে বড় ভূমিকম্প আমাদের দ্বারপ্রান্তে আছে।’
মাধবদীর ভূমিকম্পের পর ঘটনাস্থল ঘুরে এসেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন। তার মতে, একটি ভূমিকম্পের পর এ ধরনের শক স্বাভাবিক এবং মাধবদী ভূমিকম্পের পর যে তিনটি ‘আফটারশক’ হয়েছে তার মাত্রা ছিলো আগের দিনের ভূমিকম্পের চেয়ে কম।
আরও পড়ুন: নরসিংদী কেন ভূমিকম্পের কেন্দ্র?
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘কোনো একটি জায়গায় ভূমিকম্প হলে স্বভাবতই পরে কয়েক মিনিটি, ঘণ্টা বা দিনের মধ্যে ছোট ছোট বা অল্প শক্তি সম্পন্ন কম্পন অনুভূত হয়। যে ফল্ট থেকে প্রথম ভূমিকম্প হয়েছে সেখানে এডজাস্টমেন্টের জন্য হওয়া এসব ছোট কম্পনগুলো বোঝাচ্ছে যে সেখানে স্টেবল কন্ডিশনে আসতেছে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘ধরে নিতে পারি যে আপাতত কিছুটা হলেই ঝুঁকিমুক্ত। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ভূমিকম্প হবে না। হতেও পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে প্যানিক হওয়ার কিছু নেই। এই সোর্স (মাধবদী ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল) থেকে আপাতত বড় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে অন্য উৎস থেকে হতেও পারে।’
তবে ভূমিকম্পের পর আফটারশক বলতে কখন কোনটা বোঝানো হবে তা নিয়েও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫ দশমিক ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে তার ২৯০ দিনের মধ্যে ৫০ কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে ওই মাত্রার নিচের ভূমিকম্প হলে সেগুলো হবে ওই ভূমিকম্পের আফটারশক।
আবার এর তিন বছরের মধ্যে ১১০ কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে ৮ বা এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে তখন আগেরগুলো হবে ফোরশক (বড় ভূমিকম্পের আগে হওয়া ছোটো ভূ কম্পন)।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ভূতত্ত্ব) মোহাম্মদ আনিসুর রহমানসহ একটি দল মাধবদী এলাকা ঘুরে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘কোনটা ফোরশক আর কোনটা আফটারশক তা এখনি বলা কঠিন। তবে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের পর সঞ্চিত শক্তি রিলিজ হয়েছে অনেক কম সময়ে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এগুলো আফটারশক। একটা ৫.৫ মাত্রার হলে কিছু জায়গায় আরও এনার্জি রিলিজ করার সুযোগ আছে। ভূমিকম্পের জোনে আরও কয়েকটি হতে পারে। এটা ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে আফটারশক হিসেবেই বিবেচিত হবে।’
আরও পড়ুন: ভূমিকম্প নিয়ে আপাতত ‘স্বস্তির বার্তা’
ওই অধিদফতরের পরিবেশ ভূতত্ত্ব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অ্যাসেসমেন্ট শাখার দায়িত্বে থাকা উপ-পরিচালক (ভূতত্ত্ব) ড. সোহেল রানা মাধবদীর ভূমিকম্প সম্পর্কে এক প্রবন্ধে লিখেছেন যে, বাংলাদেশের টেকটনিক বিন্যাস পৃথিবীর অন্যতম জটিল ভূগাঠনিক অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। ভারতীয় প্লেটের পূর্বদিকে সাবডাকশান প্রক্রিয়া চালু থাকলেও এটি অস্বাভাবিক, স্থলভাগে ও সাধারণ সাবডাকশান বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে ভূমিকম্পের ধরন পূর্বাভাস করা কঠিন। তবে এটি বলা যায়- বাংলাদেশে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প সক্রিয় থাকবে আর বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিও উড়িয়ে দেয়া যায় না।’
বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া ধারণা অনুযায়ী, সিরিজ ভূমিকম্পে দুই ধরনের ইঙ্গিতই থাকতে পারে- প্রথমত, বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়া আর দ্বিতীয়ত, একটি ভূমিকম্পের পর সঞ্চিত থাকা শক্তি একবারে বের না হয়ে ধীরে ধীরে বের হওয়ার ফলে বারবার ভূকম্পন হওয়া।
‘তিন টেকটনিক প্লেটের অংশ বলে এখানে ভূমিকম্প হবেই। এই সাবডাকশান জোনে ৫-৬ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। সচরাচর এতে তেমন কোনো প্রভাব হওয়ার কথা নয়। শীতলক্ষ্যা নদী বা ঘোড়াশাল বরাবর ব্লাইন্ড ফল্ট আছে বলে মনে করা হচ্ছে। সাবডাকশান জোনে যে শক্তি সঞ্চিত হয় সেটাই বের হয় কখনো কখনো।-বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. বদরুদ্দোজা মিয়া।
তার মতে, সাবডাকশান জোনে অনেক ফাটল বা ফল্ট আছে। ফলে ৪-৫-৬ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়া স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিতও। জাপানে এগুলো অহরহ হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যা বা চিন্তার বিষয় হচ্ছে যেসব ভবন হয়েছে সেগুলো ৫/৬ মাত্রার ভূমিকম্প নিতে পারবে কি-না।’
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইন্ডিয়ান ও বার্মিজ প্লেটের সংঘর্ষের কারণে মাধবদীর ভূমিকম্প হচ্ছে বলা হলেও এটি যে ফল্ট থেকে হয়েছে, সেটি পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত, অথচ ইন্ডিয়ান ও বার্মিজ প্লেট বাউন্ডারি উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত।
তার মতে, দেশের অভ্যন্তরে অতীতে ৭ থেকে ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও এর বেশি কখনো হয়নি। যদিও বাংলাদেশের কাছেই মেঘালয়, আসাম ও আরাকানে হয়েছে।
সে কারণে ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে বরং সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সব বিশেষজ্ঞই। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এমআর