আব্দুল কাইয়ুম
২১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:০৩ পিএম
* প্রতি ১০০ বছর পরপর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়
* ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল
* ৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে ঢাকায় ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে
রাজধানী ঢাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক সমীক্ষা আরও একবার আতঙ্ক বাড়িয়েছে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে। পুরো রাজধানীজুড়ে প্রায় ২১ লাখ ৪৬ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাগুলো। এসব ভবনের বেশিরভাগই নির্মাণ হয়েছে নিয়ম-কানুন না মেনে, পুরোনো নকশায় বা দুর্বল ভিত্তির ওপর। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে সতর্ক করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
আরও পড়ুন:
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকা ভবনগুলোর ওপর করা এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ ভবনই ২০ থেকে ৩০ বছর আগের নির্মিত। অনেক জায়গায় রড-সিমেন্টের মান নিয়ন্ত্রণ হয়নি, আবার কোথাও অতিরিক্ত ভবন তৈরি করা হয়েছে অনুমোদিত নকশার বাইরে। ফলে সামান্য কম্পনেও এসব ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন নগরবিদরা।
বাংলাদেশ ভূমিকম্প কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, সক্রিয় ভূমিকম্প প্রবণতার মধ্যে অবস্থান করছে দেশ। বিশেষ করে ত্রিভুজাকার ভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মা প্লেটের চাপ বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের দিকে বাড়ছে। তারা বলেন, ‘ঢাকা এত ঘনবসতিপূর্ণ যে বড় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, মিরপুর ও যেসব এলাকায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভবন গড়ে উঠেছে সেসব এলাকা।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলছে, রিখটার স্কেলে শুক্রবারের ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ৫। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল নরসিংদীর মাধবদীর ১০ কিলোমিটার গভীরে। মূলত ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষে এই ভূমিকম্পের সূত্রপাত হয়।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) নরসিংদীতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে অন্তত ৬০ জন আহত হয়েছে। ঢাকা মেইলের প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদে নরসিংদী সদর ও ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের সূত্রে বলা হয়, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ জনের মতো ভূমিকম্পে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এর মাঝে ওমর নামে এক শিশু গুরুতর আহত হয়েছে। এরই মধ্যে গুরুতর আহত দুজনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও, একই জেলার পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাবস্টেশনে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এতে জাতীয় গ্রিডের সাবস্টেশনের যন্ত্রাংশ আগুনে পুড়ে যায়। পরে খবর পেয়ে পলাশ ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুটি ইউনিটের চেষ্টায় এ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এছাড়াও ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মহসিন হলের চার তলা থেকে লাফ দিয়ে একজন গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেইলের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক। পাশাপাশি, জিয়া হল, কবি জসিমউদ্দিন হল ও ফজলুল হক হল থেকে আরও তিন জন শিক্ষার্থী আতঙ্কিত হয়ে লাফ দিয়ে আহত হয়েছে। এদের একজনের পা, একজনের কোমড় ভেঙে গেছে।
এদিকে পুরান ঢাকার বংশাল এলাকায় ভূমিকম্পের সময় একটি পাঁচ তলা ভবনের রেলিং ধসে তিন পথচারী নিহত হয়েছে। এ সময় রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম মারা গেছেন।
এ ঘটনাগুলোর পাশাপাশি, ভূমিকম্প পুরো রাজধানী জুড়ে বিভিন্ন ভবনে ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় বহুতল ভবন হেলে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. জিল্লুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন এলাকা অপরিকল্পিত বহুতল ভবন তৈরি করা হয়েছে, সেসব ভবন একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকার অনেক এলাকায় ভবন তৈরি করার মতো মাটি নেই। পাশাপাশি, যারা ভবন তৈরি করছেন, তারা রাজউকের ভবন নির্মাণ সম্পর্কিত কোড মানছেন না। অনেক এলাকায় রাজউকের অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ আরও ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এছাড়াও অনেক ভবনেই নেই ভূমিকম্প সহনশীল নকশা, নেই প্রয়োজনীয় সেফটি জোন বা ফাঁকা জায়গা। সংকীর্ণ গলি, হাইরাইজ ভবন এবং অপরিকল্পিত বৈদ্যুতিক-গ্যাস সংযোগও বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
আমরা চাই, সরকার অবিলম্বে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করে সংস্কারের পদক্ষেপ নেবে। পাশাপাশি ভবনের নকশা অনুমোদনে কঠোরতা, নিয়মিত পরিদর্শন, এবং জনগণকে ভূমিকম্প প্রস্তুতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
এদিকে রাজউকের তথ্য মতে ২০১০ সালে প্রথম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করা হয়। পরে ২০১৬ সালে তালিকাটি হালনাগাদ করা হয়। তাদের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। এছাড়া বিধিবিধান লঙ্ঘন করে নির্মিত ভবন রয়েছে পাঁচ হাজার। অতিঝুঁকিপূর্ণ ৩২১টি ভবনের বেশির ভাগই রয়েছে পুরান ঢাকায়। এর মধ্যে সূত্রাপুর থানা এলাকায় রয়েছে ১৪৬টি, কোতোয়ালিতে ১২৬টি ও লালবাগে ২৮টি। বাকি ২১টির মধ্যে মোহাম্মদপুরে ছয়টি, ডেমরায় তিনটি, মিরপুরে সাতটি, রমনায় একটি, তেজগাঁওয়ে একটি, মতিঝিলে দুটি ও ধানমন্ডিতে একটি। তবে ২০১৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সুনির্দিষ্ট তথ্য তাদের কাছে নেই।
এক জরিপে দেখা যায়, সবশেষ ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। প্রতি ১০০ বছর পর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। সেই হিসাবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে বড় ভূমিকম্পের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে। এছাড়া এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ।
একেএস/ক.ম