ঢাকা মেইল ডেস্ক
১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:৪৬ পিএম
‘চিকেন নেক’ হিসেবে পরিচিত পশ্চিবঙ্গের শিলিগুড়ি করিডোর ঘিরে সম্প্রতি ভারতের কিছু সামরিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অবস্থিত আসাম ও উত্তর দিনাজপুরে দুটি সেনা ঘাঁটি স্থাপন করছে দেশটি। এ নিয়ে দুই দেশে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, শিলিগুড়ি করিডোরের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই সম্ভবত ভারতের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মূল উদ্দেশ্য। একইসঙ্গে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে নতুন ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও এই সামরিক তৎপরতার পেছনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্লেষকদের কথায়, চিকেনস নেক তথা শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে খুবই স্পর্শকাতর একটি এলাকা। এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য বা সেভেন সিস্টার্সকে সংযুক্ত করেছে। আবার এই এলাকায় একাধিক দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে।
এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য চীনের যে তৎপর রয়েছে, সেটিকে মোকাবিলাও ভারতের একটি বড় লক্ষ্য বলে সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন।
এদিকে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ভারতের এই সামরিক তৎপরতা নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে, তখন লালমনিরহাটে সীমান্তের ৬২ কিলোমিটার ভারতের দখলে চলে গেছে- এমন একটি গুজবও ছড়ানো হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ নিয়ে কী বলছেন স্থানীয় বাংলাদেশিরা?
লালমনিরহাটে কী পরিস্থিতি
এই জেলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে ৩৪৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে ৬২ কিলোমিটার ভারতের দখলে চলে যাওয়ার যে গুঞ্জন উঠেছে, সেটির সত্যতা জানতে লালমনিরহাট বিজিবির কর্মকর্তারা সরেজমিনে সীমান্ত পরিদর্শন করেন।
এরপর ১৫ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী ইমাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘লালমনিরহাট সীমান্ত নিয়ে ‘বিভ্রান্তিকর’ তথ্য ছড়ানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এটা আমারও নজরে পড়েছে যে, লালমনিরহাটের প্রায় ৬২ কিলোমিটার এলাকা পার্শ্ববর্তী দেশের সেনাবাহিনী দখলে নিয়েছে। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এটা সম্পূর্ণ গুজব। এর মূল উদ্দেশ্য স্থানীয় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। এই এলাকার প্রত্যেকটা মানুষ সাচ্ছন্দ্যে এলাকায় আছে, বিজিবি টহলে আছে। বিজিবি সরে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।’
সীমান্তের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন বিজিবির এই কর্মকর্তা। তিনি জানান, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং যৌথ টহলও চলছে বিজিবির।
ধরলা নদী ভারত-বাংলাদেশের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। লালমনিরহাট সীমান্তে মোগলহাট বিওপির কাছে এই নদী দুই দেশে বিভক্ত। মোগলহাটে ধরলা নদীর তীরে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশের বাসিন্দারা সীমান্তের নির্দিষ্ট দূরত্বে মাঠে কাজ এবং নৌকা চালানোর মতো স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড করছেন। মোগলহাট সীমান্ত চৌকিতে পাহারায় আছেন সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্যরা।

সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানান, জমি ভারতের দখলে চলে যাওয়ার মতো এ ধরনের কিছু লালমনিরহাট সীমান্তে ঘটেনি। একজন স্থানীয় মেম্বার বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ ভুয়া খবর। বানোয়াট কথা।’
সীমান্ত এলাকার গ্রামবাসী জানায়, সৈন্য সমাবেশ বা অনুপ্রবেশের মতো কোনো ঘটনার অস্তিত্ব নেই। তবে সীমান্তের কাছে যাদের বাড়িঘর ও জমিজমা আছে এবং মাঠে চাষাবাদ ও কাজকর্মে নিয়মিত যাতায়াত করেন, তাদের অভিজ্ঞতা হলো- ভারতীয় বিএসএফ বেশ কড়া পাহারা দিচ্ছে।’
গত বছরের ৫ অগাস্টের পর থেকে লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে। সীমান্তে তাদের টহল এবং জনবল বৃদ্ধির বিষয়টি নজরে এসেছে স্থানীয়দের।
শিল্পী বেগম নামে একজন জানান, ‘আগে নিয়মিত সীমান্তের কাছে গেলেও এখন সেখানে যান না। বিএসএফ সদস্যরা সীমান্তে নিরাপত্তা টহল বাড়িয়েছে। আগে ৫-৬ জন টহল দিত, এখন ১৫-১৬ জন দেয়। এখন ঝুপড়িও (অস্থায়ী টহল চৌকি) বাড়াইছে। লোকও বাড়াইছে।’
সীমান্তে বিএসএফের গুলির ঘটনাও থেমে নেই। গত ১১ নভেম্বরে ভারতে অনুপ্রবেশের পর বিএসএফ গুলি চালিয়েছে। এ ঘটনায় তিনজন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভারত সীমান্তে বিএসএফের নজরদারি বৃদ্ধির বিষয়টি যেমন আছে, একইসঙ্গে শিলিগুড়ি করিডোরকে ঘিরে ভারতের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিরও খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এ বছরের শুরুতে ভারতের তিন বাহিনীর সম্মিলিত একটি বড় ধরনের সামরিক মহড়া হয়েছে শিলিগুড়ি করিডোর এলাকায়।
সীমান্তের কাছে ভারত কী করছে
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অন্তত দুটি নতুন সেনা ঘাঁটি তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো হলো আসামের ধুবরি এবং উত্তর দিনাজপুরে চোপরা সেনা ঘাঁটি। এই জায়গা দুটি বাংলাদেশ সীমান্তের খুবই কাছাকাছি।
ভারতের অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জী বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এটি এক ধরনের সক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ। কৌশলগত শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের জন্য স্পর্শকাতর একটি জায়গা। বর্ডারে বিএসএফ এরই দায়িত্ব, আর্মি ওখানে একেবারেই ডিপ্লয়েড নয়। এটা সাধারণ সময় আর্মির কোনো রেসপনসিবিলিটি নেই এখানে। তাদের কিছু এস্টাবলিশমেন্ট র্যাশনালাইজ করা হচ্ছে এখানে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অমিত শাহ সীমান্তে সতর্কতামূলক কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছেন এবং চিকেন নেক সেটারই একটা অংশ। ডোকলাম থেকে শিলিগুড়ি করিডোর ‘ওখানটায় একটা সেনসিটিভ সিচ্যুয়েশন’ আছে বলে মনে করছে ভারত এবং আমাদের যুক্তিসঙ্গত কারণে প্রস্তুত থাকতে হবে।’
কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে কি না- এমন প্রশ্নে দীপঙ্কর ব্যানার্জী বলেন, ‘বিষয়টা সেরকম নয়। ভারতবর্ষের দিক থেকে একেবারে কোনো সম্পর্ক নাই। বরং এটা সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানোর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, বিশেষ করে চীনের কথা মাথায় রেখে।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালের আগে থেকেই যে লার্জ স্কেলে অনুপ্রবেশ হয়েছে, এটা বাস্তবতা। ইন্ডিয়ার জন্য ৩০-৪০ বছর ধরে এটা একটা সমস্যা ছিল, এখনো চলে যায়নি। সেটা আমাদের ভেবে রাখতে হবে।’
বাংলাদেশে কী মূল্যায়ন
এ সম্পর্কে লালমনিরহাট বিজিবির অধিনায়ক বা সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী ইমাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটার সঙ্গে সীমান্তরক্ষী ফোর্স হিসেবে আমি আমার বর্ডারে এমন কোনো সমাবেশ দেখিনি। যে কারণে আমি উদ্বিগ্ন হবো বা আমাদের উদ্বেগের কথা জানাবো। এখন পর্যন্ত সেরকম কিছু দেখিনি।’
তার কথায়, ‘সীমান্তে নির্দিষ্ট দূরত্বে ভারত তাদের বেইজ করতেই পারে। সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। শিলিগুড়ি করিডোরে শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে বর্ডার না, এখানে অন্য দেশের সঙ্গেও সীমান্ত আছে। তারা তাদের প্রয়োজনে করতেই পারে। এটা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত মুভমেন্ট। যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা আমাদের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়।’
মেহেদী ইমাম আরও বলেন, ‘কোনোকিছু যদি আমার বর্ডারে দেখি, যেটা আমাদের সার্বভৌমত্ব বা বর্ডার রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে, বর্ডারের নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে সেই নিয়মের বহির্ভূত কিছু হচ্ছে- তখন সেটা আমার উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে যদি তারা (ভারত) কিছু করে, সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’
বাংলাদেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ভারত খুব হিসেব-নিকেশ করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে ঘাঁটির অবস্থান এবং কোন সময়ে করছে, অর্থাৎ টাইমিং- দুটিই গুরুত্বপূর্ণ।’
তার বিশ্লেষণে ভারতের এই পদক্ষেপের নেপথ্যে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তা, চীনকে মোকাবিলা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনে এক ধরনের হুমকি অনুভব করা। তিনি বলেন, ‘শিলিগুড়ি করিডোর সেভেন সিস্টার্সকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এটার ইমপর্টেন্স টাইম রেলিভেন্স অনুযায়ী এখন আরও বেড়ে গেছে। তাৎপর্য আরও বেড়েছে।’
নাঈম আশফাক বলেন, ‘অন্যদিকে যদি জিও-স্ট্র্যাটিজিক জিনিসগুলো চিন্তা করি, যে চাইনিজ এক্সপানশন নীতিতে আছে একদিকে সিপ্যাক- চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর, এদিকে সিম্যাক-চায়না মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর করেছে। ফলে তার (চীন) যে এক ধরনের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, এটা যদি সে এইদিকে কানেক্ট করে ফেলে, তাহলে তার যে এই অঞ্চলে, সাউথ এশিয়াতে প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী যাকে আমরা বলি, তাকে কিন্তু সে দুর্বল করে ফেলতে পারে। এইটাকে কিন্তু ইন্ডিয়ার মাথায় রাখতেই হচ্ছে।’
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাংলাদেশে ও পাকিস্তানের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সামরিক যোগাযোগ তৈরি হয়েছে, যা ভারতের জন্য পছন্দের নয় এবং তারা এই যোগাযোগকে সন্দেহের চোখে দেখে বলে অনেকে মনে করেন।
এছাড়া শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে লালমনিরহাট বিমানবন্দর ও তিস্তা প্রকল্পে চীনের দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতিও ভারত পছন্দ করে না- এমন বিশ্লেষণ জানাচ্ছেন নাঈম আশফাক চৌধুরী।
তার মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, একইসঙ্গে কিছু প্রকল্প, বিশেষ করে তিস্তা ব্যারেজ ভারতের উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকতে পারে। আলোচনা হচ্ছে, চীনকে পুরো তিস্তা প্রকল্প ১০০ বছরের চিন্তা করে দিতে পারে কি না, সেখানে শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে চীনের অবস্থানকে ভারত এক ধরনের ‘থ্রেট’ মনে করতে পারে। এটাও সীমান্তে তাদের সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর একটা কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল নাইম আশফাক চৌধুরী ভারতের সামরিক তৎপরতাকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কোনো অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে দেখেন না। তবে সীমান্তের কাছে এ সামরিক পদক্ষেপের ‘সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে’ বলে তিনি মনে করেন।
আশফাক চৌধুরী বলেন, ‘৫ অগাস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রয়েছে, এখনো নির্বাচিত সরকার আসেনি এবং আমাদের নিরাপত্তার যে অবস্থাটা আছে, সেই অবস্থা থেকেও তারা (ভারত) কিছুটা থ্রেট ফিল করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমি এটাকে অস্বাভাবিক কোনো জিনিস দেখছি না। বাট বাংলাদেশ শুড ওয়ার্ক ভেরি কেয়ারফুলি। লাইক মিলিটারি ডিপ্লোমেসি, কানেকটিভিটি উইথ মিলিটারি টু মিলিটারি সেটা কন্টিনিউ করতে হবে।’
ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক দীপঙ্কর বলছেন, ‘বাংলাদেশকে সামরিক দিক থেকে ভারত কোনো হুমকি হিসেবে দেখে না। বাংলাদেশ থেকে যে কোনোরকম একটা মিলিটারি থ্রেট হতে পারে, এটা আমরা একসেপ্ট করি না।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের পশ্চিমে পাকিস্তান সীমান্তে নিয়মিত গণ্ডগোল চলে। পূর্বাঞ্চল সীমান্তে বাংলাদেশকে ভারত শত্রুজ্ঞান করেনি। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে কৌশলগত অবস্থান থেকে অন্য কেউ যদি ব্যবহারের সুযোগ নেয়, সেটা অবশ্যই ভারতের দুশ্চিন্তার জায়গা। সূত্র: বিবিসি বাংলা
এএইচ