images

জাতীয়

পরপর তিন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, নেপথ্যে কী?

আব্দুল হাকিম

১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩৬ পিএম

# নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও জরুরি রুটের ঘাটতি
# দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণের অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা
# বৈদ্যুতিক লোডের অতিরিক্ত চাপ ও ঝুঁকি
# ফায়ার সার্ভিস ও আধুনিক রোবট ব্যবহার
# প্রতিক্রিয়াশীল না হয়ে পরিকল্পিত প্রতিরোধের তাগিদ
# সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা ও নিয়মিত তত্ত্বাবধানের ওপর গুরুত্ব

দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নতুন নয়। কোথাও আগুন লাগলে এবং প্রাণহানি হলে, এ ধরনের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটতেই থাকে। এমনটা প্রায়ই দেখা যায়। তবে গত ৫ দিনে ভয়াবহ তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এগুলো কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি নেপথ্যে রয়েছে অন্য কারণ, উঠেছে সেই প্রশ্ন।

সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডের প্রথম শিকার হয় ঢাকার মিরপুরের শিয়ালবাড়ির একটি কেমিক্যালের গুদাম। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে পাশের একটি পোশাক কারখানায়। প্রথমে ধোঁয়া এবং বিষাক্ত গ্যাসে অচেতন হয়ে এবং পরে পুড়ে মৃত্যু হয় ১৬ শ্রমিকের। এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও কয়েকজন। ১৭ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আসে সেই আগুন। 

Mirpur
মিরপুরে পোশাক কারখানা ও কেমিক্যাল গুদামে অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য। ছবি- সংগৃহীত

এরপর ১৬ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ওই ভবনে ছিল একটি তোয়ালে কারখানা এবং মেডিকেলের সরঞ্জাম তৈরির একটি কারখানা। আগুনে এই দুটি কারখানাসহ পুড়ে কঙ্কাল হয়ে যায় সাততলা বিশিষ্ট পুরো ভবনটি। ফায়ার সার্ভিসের ২০টির বেশি ইউনিট, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টার পরও সেই আগুন নেভাতে লেগেছে প্রায় ১৮ ঘণ্টা! যদিও কারখানাগুলোতে কর্মরত শ্রমিক এবং অন্যরা আগেই আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে যথাসময়ে বের হয়ে যাওয়ায় এ ঘটনায় কোনো প্রাণহানি হয়। তবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। 

সবশেষ শনিবার (১৮ অক্টোবর) ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৩৬টি ইউনিট। এছাড়া কাজ করছেন সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর সদস্যরাও। 

CEPZ-fire
চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকায় কারখানা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য। ছবি- সংগৃহীত

এদিন দুপুর আড়াইটার দিকে কার্গো ভিলেজে লাগা আগুন মুহূর্তে পাশে থাকা কেমিক্যাল গোডাউনে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আগুন আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। সাত ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে সেই আগুন। তার আগে পুড়ে গেছে কার্গো ভিলেজের শত শত টন মালামাল। যদিও প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি। মাত্র ৫ দিনের মধ্যে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ড দেশের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাই যেন প্রকাশ করেছে।

এই তিনটি ঘটনার মধ্যে দেখা গেছে, শুধু দুর্ঘটনার সময়কার প্রতিক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ না থেকে প্রিভেনশন বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। জরুরি সিঁড়ি ও এক্সিট রুট না থাকায় কর্মীরা আটকা পড়ে। দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আইনগত ও নিয়ন্ত্রক তত্ত্বাবধানে ঘাটতি স্পষ্ট। বৈদ্যুতিক লোডের অপ্রতুল ব্যবস্থাপনা আগুন লাগার ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

S_Lead_20251018_154410998
শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের একটি দৃশ্য। ছবি- সংগৃহীত

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও গুদামে আগুন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। দাহ্য ও বিষাক্ত পদার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করা, জরুরি সিঁড়ি ও এক্সিট রুট ঠিকভাবে রাখা, ফায়ার এলার্ম সিস্টেম কার্যকরভাবে স্থাপন এবং নিয়মিত তত্ত্বাবধানে মনোযোগ দেওয়া অপরিহার্য। আগুন লাগার ঝুঁকি কমাতে এসব মৌলিক পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। 

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, অনিয়ম ও অবহেলার ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধু প্রতিক্রিয়াশীলভাবে কাজ করলে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না, পরিকল্পিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকলে বড় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একাধিক সংস্থা একত্রিতভাবে রিয়েল‑টাইম ফায়ার রেসপন্স ব্যবস্থা গড়ে তুললে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব এবং ভবিষ্যতের দুর্ঘটনা এড়ানো সহজ হয়। নিরাপত্তার এসব ব্যবস্থা মেনে চললে শুধু প্রাণহানি নয়, অর্থনৈতিক ক্ষয়ও কমানো সম্ভব। সুতরাং শিল্প ও গুদামে আগুন প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি ব্যবহার একযোগে বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

_n
শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে আগুন নেভাতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ছবি- ঢাকা মেইল

অগ্নিকাণ্ডগুলোর মধ্যে মিরপুরের পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার মূল কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা উল্লেখ করছেন নিরাপত্তা ব্যবস্থার তীব্র ঘাটতি। জরুরি সিঁড়ি না থাকা, এক্সিট রুটের সীমাবদ্ধতা এবং দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণের অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি করেছে। এছাড়া কর্মীদের উদ্ধার ব্যবস্থা ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অপর্যাপ্ত থাকার কারণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রামের ইপিজেডে আগুন লাগার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক লোডের অতিরিক্ত চাপ, পুরনো যন্ত্রপাতি এবং গুদামজাত দাহ্য পদার্থের অনিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণ আগুন বিস্তারকে ত্বরান্বিত করেছে। ভবনের পরিকল্পনাগত দুর্বলতা যেমন জরুরি সিঁড়ি ও ফায়ার এলার্মের অভাবও নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করেছে। তদুপরি, অননুমোদিত গুদাম ব্যবহার এবং তদারকির ঘাটতি আগুন নেভাতে সময় ব্যয় করেছে।

n2
শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে আসে বিজিবির সদস্যরাও। ছবি- ঢাকা মেইল

বিমানবন্দর কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার পেছনে মূল কারণ হিসেবে দাহ্য পণ্য ও রাসায়নিক দ্রব্যের সংরক্ষণ, নিরাপত্তা তদারকির অভাব এবং দ্রুত বিস্তৃত আগুনের প্রতিক্রিয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতির ঘাটতি চিহ্নিত করা যায়। এখানে আধুনিক রিমোট কন্ট্রোল ফায়ারফাইটিং রোবট ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে।

এই তিন ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে, শুধু দুর্ঘটনার সময়কার প্রতিক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকলে বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব নয়। দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ, জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নিয়মিত তত্ত্বাবধান এবং কার্যকর তত্ত্বাবধানে ঘাটতি থাকা আগুন লাগার মূল কারণ হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। প্রতিটি শিল্প, গুদাম ও সংস্থায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার না করলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো কঠিন হবে।

S
শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে আগুন নেভাতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ছবি- ঢাকা মেইল

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মাদ কাউছার মাহমুদ জানান, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যখন আমরা বিজ্ঞপ্তি পাঠাই, সে সময় কার্গো ভিলেজের উত্তর পাশের দ্বিতীয় তলায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। সেই অংশে ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি গাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল।

তিনি বলেন, শনিবার দুপুর ২টা ১৫ মিনিটের দিকে আগুন লাগার খবর পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন, ফায়ার সার্ভিস এবং বিমানবাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করে। নিরাপত্তার স্বার্থে সব রুটের ফ্লাইট চলাচল সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে তা আবার চালু হয়েছে।

এএইচ/এএইচ