আব্দুল কাইয়ুম
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৩৭ পিএম
- হানি ট্র্যাপের মাধ্যমে বয়স্ক লোকদের সুগার ড্যাডি বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে
- চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে অফিসে কথা বলতে গিয়ে শিকার হচ্ছেন হানি ট্র্যাপে
- রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও বিত্তশালীরা হানি ট্র্যাপের মূল টার্গেট
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকা হানি ট্র্যাপ চক্রের মূল হোতারা পুলিশের জালে ধরা পড়তে শুরু করেছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তারা রাজনীতিবিদ, চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল। নারীদের দিয়ে প্রেম বা বন্ধুত্বের প্রলোভন দেখিয়ে ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও সংগ্রহের পর ব্ল্যাকমেইল করাই ছিল এ চক্রের প্রধান কৌশল।
সম্প্রতি (১৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বারিধারা এলাকা থেকে মামুন আহমেদ নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে গুলশান থানা পুলিশের একটি দল।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মামুন নিজেকে এফবিআই এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দিত। অতীতে সরকারি আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিকে নারী দিয়ে ট্র্যাপে ফেলে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করত। এসব ভিডিও দিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল করে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করাই ছিল মামুনের অন্যতম প্রধান কাজ। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ভুয়া সিআইএ এজেন্ট এনায়েত করিমের সঙ্গেও মামুনের যোগাযোগ ছিল। প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের সামী এক পোস্টে বিষয়টি প্রকাশ করেন।
এছাড়া, ২০২০ সালে বারিধারার একটি বাসা থেকে কোটি টাকা মূল্যের কয়েকটি ঘড়ি চুরির ঘটনায়ও মামুন আলোচনায় আসেন। সে সময় প্যাটেক ফিলিপ, রিশার্ড মিল, বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের কোটি টাকা দামের ঘড়িগুলো মাত্র কয়েক হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয় চোর চক্র। ওই ঘড়িগুলো গুলশানের বারিধারা পার্ক রোডের মামুনের বাসা থেকেই চুরি হয়েছিল।
গুলশান থানার এসআই মাসুম বিল্লাহ এ মামলার তদন্ত করেন। তিনি জানান, পাঁচটি ঘড়ির মধ্যে দুটি ছিল স্বর্ণের। স্বর্ণ গলিয়ে ফেলায় সেগুলো উদ্ধার করা যায়নি। তবে স্বর্ণের ঘড়ি বিক্রি করে পাওয়া এক লাখ তিন হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল। এ ছাড়া তিনটি ঘড়ি ও একটি আইফোন উদ্ধার করা হয়।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মামুন আহমেদ বারিধারার ওই বাসায় একাই থাকতেন। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা, মডেল ও নায়িকারা। তিনি নিজেকে এফবিআই এজেন্ট ও সাবেক র্যাবপ্রধান বেনজির আহমেদের আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দিতেন।
সম্প্রতি বিএনপির পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি আশরাফ আলী হাওলাদার হানি ট্র্যাপের ফাঁদে পড়েন। ভুক্তভোগী আশরাফ এ ঘটনায় মামলা করলে ফারজানা বেগম (২৪) নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলায় আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়। পুলিশ জানায়, ফারজানার কাছ থেকে টাকা, একটি মোবাইল ও সিমকার্ডসহ বিভিন্ন প্রমাণ উদ্ধার করা হয়েছে।
মির্জাগঞ্জ থানার ওসি মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বয়স্ক বিত্তবানদের টার্গেট করে হানি ট্র্যাপে ফেলে অর্থ আত্মসাৎ করাই তাদের কাজ। প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অন্যদের ধরতে অভিযান চলছে।
এদিকে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুই কেবিন ক্রু—খাদিজা সুলতানা শিমু ও এমএসটি মৌরির বিরুদ্ধে হানি ট্র্যাপ ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিমান কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করেছে। অভিযোগকারীরা বলছেন, সম্পর্ক গড়ে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা নগদ অর্থ ও দামী উপহার নিয়েছেন।
একজন কাতার প্রবাসী (ছদ্মনাম সৌরভ) অভিযোগ করেন, মৌরি তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নানা অজুহাতে অর্থ ও উপহার নিয়েছেন। পরে আরও কয়েকজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। একইভাবে শিমুর বিরুদ্ধে ঢাকার এক বেসরকারি এয়ারলাইন্স কর্মকর্তা প্রায় ২২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন।
উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই তানভির আলম বলেন, প্রাথমিকভাবে প্রেমের সম্পর্কের সত্যতা মিলেছে। তবে বিষয়টি তদন্তাধীন। প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র এস এম রওশন কবীর বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরাধ করলে কেউ ছাড় পাবে না।
এ ছাড়া, গত ২১ আগস্ট রাজধানীর শেওড়াপাড়া ও তেজগাঁও এলাকা থেকে হানি ট্র্যাপ ও চাকরির প্রলোভনে প্রতারণার ঘটনায় সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি মিরপুর বিভাগ। তারা মারধর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নগদ টাকা ও মোবাইল হাতিয়ে নিত। এ ঘটনায়ও মামলা হয়েছে।
হানি ট্র্যাপ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, হানি ট্র্যাপ মূলত ব্ল্যাকমেইল, অর্থ আদায় ও তথ্য ফাঁস করার হাতিয়ার। এতে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও ব্যবহার করে তাকে জিম্মি করা হয়। ফলে এটি শুধু প্রতারণা নয়, গুরুতর সাইবার অপরাধও। ভুক্তভোগীরা সামাজিক লজ্জার ভয়ে অভিযোগ করতে সাহস পান না। এই নীরবতা অপরাধীদের আরও সক্রিয় করে তোলে। তাই জনসচেতনতা বাড়ানো এবং ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো খুব জরুরি।
একেএস/এআর