images

জাতীয়

রিকশা: প্যাডেল থেকে ব্যাটারি, নগরীর স্বস্তি নাকি সড়কের বিপদ?

মাহফুজুর রহমান

০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৫ পিএম

যান্ত্রিক শহর ঢাকায় সকাল শুরু হয় ঘণ্টার শব্দে। একের পর এক রিকশার টুংটাং, মানুষের হাকডাক, আর চাকার ঘূর্ণন- সব মিলে তৈরি করে এক অনন্য সুর। 

বহু আগে থেকেই ঢাকাকে বলা হয় ‘রিকশার শহর‘। প্রতিদিন এক মিলিয়নেরও বেশি রিকশা চলাচল করে এই শহরে। অথচ লাইসেন্সপ্রাপ্ত মাত্র কয়েক হাজার। এই বিপুল সংখ্যক বাহনের পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের শ্রম, কষ্ট, স্বপ্ন আর সংগ্রামের গল্প।

আন্তর্জাতিকভাবে রিকশাকে অনেকেই শুধু একটি অদ্ভুত রঙিন বাহন হিসেবে চেনে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে রিকশা কেবল পরিবহন নয়, এটি জীবনধারণের উপায়, সংস্কৃতির অংশ, এমনকি শিল্পেরও মাধ্যম। 

R1

ঢাকা শহরকে কেউ যদি এক বিশাল দেহের সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে তার প্রাণপ্রবাহ হলো রিকশা। সকাল থেকে রাত- পুরো নগরজীবনের সঞ্চালক এই তিন চাকার বাহন। 

প্রতিদিন কোটি মানুষের যাতায়াতের অবলম্বন হয়ে থাকা রিকশা কেবল একটি যানবাহন নয়, এটি শ্রম, সংস্কৃতি আর সংগ্রামের প্রতীক। একদিকে রিকশাওয়ালার ঘামে ভিজে আছে এর প্রতিটি প্যাডেল, অন্যদিকে আঁকিবুঁকির নকশায় ভেসে ওঠে নগরীর লোকসংস্কৃতি।

কিন্তু গত এক দশকে ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে ঢাকার রাস্তায় ভিন্ন এক বাস্তবতা দেখা যায়। প্রথমে গ্রামীণ জনপদে সীমিত আকারে চলতে শুরু করলেও এখন নগরের প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় এগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। সহজলভ্যতা ও কম খরচের কারণে যাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় হলেও দুর্ঘটনা আর সড়ক নিরাপত্তার দিক থেকে এই রিকশাগুলো শহরের নতুন এক আতঙ্ক।

R2

রিকশার ইতিহাস

এই বাহনটির উৎপত্তি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও ধারণা করা হয়, উনিশ শতকের শেষ দিকে জাপানে এর সৃষ্টি । পরে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে রিকশার সূচনা ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৯৩৮ সালে চট্টগ্রামে প্রথম রিকশা চালু হয়। সেখান থেকে ক্রমে ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

স্বাধীনতার পর ঢাকায় রিকশার ব্যবহার দ্রুত বাড়তে থাকে। আশির দশকে নগরের প্রধান পরিবহন হিসেবে এটি জায়গা করে নেয়। বর্তমানে ঢাকায় অনুমোদিত রিকশার সংখ্যা প্রায় ৭৯ হাজার হলেও অননুমোদিত রিকশার সংখ্যা সব মিলিয়ে কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

R3

রিকশাওয়ালার ঘামে লেখা জীবন

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে রিকশাওয়ালাদের অধিকাংশই গ্রামের দরিদ্র মানুষ। কৃষিকাজে স্বাবলম্বী হতে না পেরে তারা জীবিকার সন্ধানে শহরে আসেন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ১২–১৪ ঘণ্টা পরিশ্রমের পর একজন চালকের দৈনিক আয় হয় গড়ে ৮০০–১৬০০ টাকা। তবে ভাড়া, খাবার, গ্যারেজ খরচ বাদ দিলে হাতে থাকে ৪০০–১০০০ টাকা।

রশিদ নামে এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তার জীবনের কঠিন বাস্তবতা। তিনি বলেন,  ‘ভাই, সকালে গ্যারেজে রিকশার ভাড়া দিই ২০০ টাকা। সারাদিন খেটে সন্ধ্যায় হাতে থাকে ৫০০–৭০০। সেই টাকা দিয়েই সংসার চালাই। বাচ্চাদের স্কুলে পড়াইতে চাই, কিন্তু খরচ সামলাই কেমনে?’

R4

সংস্কৃতির বাহন

রিকশা শুধু পরিবহন নয়, এটি ঢাকার নগর সংস্কৃতির প্রতীক। রিকশা পেইন্টিং এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফোক আর্ট। বিদেশি পর্যটকরা ঢাকায় এসে রিকশা ভ্রমণকে এক বিশেষ অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘রিকশার ভিজ্যুয়াল কালচার আসলে শহরের মানুষকে এক ধরনের বিনোদন দেয়। সিনেমার নায়ক-নায়িকা, পশুপাখি, গ্রামীণ দৃশ্য- এসব নকশা শহরে লোকজ সংস্কৃতির উপস্থিতি টিকিয়ে রেখেছে।’

ঢাকার অর্থনীতিতেও রিকশার অবদান কম নয়। গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় এক কোটি যাত্রী রিকশায় চলাচল করে। নগরের ছোট দূরত্বে মানুষের প্রধান ভরসা এই বাহন।

রিকশা শিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আছেন চালক, মালিক, গ্যারেজ ব্যবসায়ী, মেকানিক, শিল্পী সব মিলিয়ে কয়েক লাখ মানুষ। রিকশা শুধু যাতায়াতের মাধ্যম নয়, এটি এক বিশাল কর্মসংস্থানের খাত।

R5

ব্যাটারিচালিত রিকশা: সহজলভ্যতা বনাম বিপদ

প্রায় এক দশক আগে ব্যাটারিচালিত রিকশা সীমিত আকারে ঢাকায় প্রবেশ করে। একসময় গ্রামীণ জনপদে এগুলো ‘অটোরিকশা’ নামে পরিচিত ছিল। কম খরচ, সহজ চালনা ও দ্রুতগতির জন্য সহজেই এগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়কে এক ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে। এগুলোর কোনো বৈধ নিবন্ধন নেই, চালকরা প্রশিক্ষণহীন এবং এগুলোর ব্রেক, লাইটসহ সেফটি ফিচারও অনুপস্থিত। ফলে দুর্ঘটনার হারও বাড়ছে।

R6

দুর্ঘটনার তথ্য

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)–এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ ব্যাটারিচালিত যানবাহনের কারণে ঘটে। ২০২৩ সালে দেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনার ১৪ শতাংশ ঘটেছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যানের কারণে। শুধু ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রতিমাসে গড়ে ৫০–৬০টি দুর্ঘটনায় এসব যান জড়িত। অধিকাংশ দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগী হয় স্কুলগামী শিশু, বয়স্ক মানুষ ও নারী যাত্রী।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) অনুসারে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ব্যাটারিচালিত ত্রিচক্রী সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৯০০টি, যার মধ্যে ৫৮২টি ছিল প্রাণঘাতী। অন্যদিকে এক বিশ্লেষণে বলা হয়, গত সাত বছরে বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৮.৬ শতাংশ ছিল ব্যাটারিচালিত রিকশা সম্পর্কিত ।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে অননুমোদিত ত্রিচক্রী যানগুলোর জন্য দেশে ৩,৩০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। শুধু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতেই ৪০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারায় এমন ত্রিচক্রী যানের কারণে।

R7

এছাড়া রাজধানী ঢাকায় ২০২৪ সালে মোট ৩৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৬ জন নিহত হয়, যেখানে ত্রিচক্রীর কারণে জাতীয়ভাবে ১,৩৯২ জনের মৃত্যু হয়, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ১৯ শতাংশ।

২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দেন। তবে তা স্থায়ী হয়নি। কারণ চালক ও মালিকদের প্রবল প্রতিবাদ এবং মানবিকতার কারণে আপিল বিভাগ সে আদেশ স্থগিত করে। 

পুলিশ ও সিটি করপোরেশনও নানা সময়ে বিভিন্ন অভিযান চালিয়েছে, এখনো চালায়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রায় ২০ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করে, যার মধ্যে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন, সিট জব্দ ও ব্যাটারি বাজেয়াপ্ত হয়। 

R8

চলতি বছরের মে মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ঘোষণা করে, প্রধান সড়ক থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ হবে এবং ওয়ার্কশপ ও চার্জিং পয়েন্টও বন্ধ করা হবে। প্রশাসকরা বলছেন, ২০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এই যানগুলো দায়ী।

সরকার একাধিকবার ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও রাজনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে তা কার্যকর হয়নি। 

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছিলেন, জাতীয়ভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা বৈধকরণ করা হবে। তবে হাইওয়েতে চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে। বৈধকরণের জন্য চালক লাইসেন্স, রুট পারমিট, ড্রাইভার প্রশিক্ষণ, ব্যাটারি নিষ্কাশন নীতি ও চার্জিং স্টেশন নিয়ন্ত্রণের মতো নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করা হবে।

R9

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার মূলত নগর পরিবহন নীতির ব্যর্থতার ফল। কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ বিকল্প হিসেবে এগুলোর ওপর নির্ভর করছে।

বাংলাদেশের মতো ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানেও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে। তবে সেসব দেশে নির্দিষ্ট লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন ও সড়ক নিরাপত্তা আইন কার্যকর করা হয়েছে। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তুলনামূলক কম। বাংলাদেশে এখনো এসব যানবাহনের কোনো বৈধ কাঠামো না থাকায় সমস্যা বাড়ছে।

রিকশা শ্রমজীবী মানুষের ঘাম আর শিল্পীদের রঙে রঙিন এক ঐতিহ্য। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশার ঝুঁকি, যা নগরের সড়ক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এই ‘বিপদের চাকা’ একদিন নগরজীবনকে অচল করে দিতে পারে।

এএইচ