মো. মেহেদী হাসান হাসিব
২০ আগস্ট ২০২৫, ০৪:২৪ পিএম
খাইরুল ও তরিকুল দুই ভাই। সাদিয়া নামের এক মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেন রবিউল। পরবর্তী সময়ে সাদিয়া তরিকুলকে ভালোবাসেন এমন দাবি করলে রবিউল তাকে তালাক দেন এবং সাদিয়া তারই ভাই তরিকুলকে বিয়ে করে একই বাসায় এসে উঠেন। ঘটনাটি ঝিনাইদহের শিবানন্দপুর গ্রামের। পরে জানা যায় সাদিয়া একজন রোহিঙ্গা।
প্রায় আট বছর আগে ২০১৭ সালে গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গারা এসে কক্সবাজারে অবস্থান করে। সব মিলিয়ে উপকূলীয় জেলাটিতে রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। দিন দিন তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ শত চেষ্টা করেও গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গা নাগরিককেও ফেরাতে পারেনি নিজ দেশে। ফলে মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও এখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের মরিয়া চেষ্টা করছে তাদের কেউ কেউ। সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরও রোহিঙ্গারা ভোটার তালিকায় ঢুকে যাচ্ছে। কক্সবাজারসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপক কড়াকড়ি হওয়ার কারণে তারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা অঞ্চলে।
দুই ভাইকে যেভাবে বিয়ে করেন সাদিয়া
প্রায় দুই বছর আগে ইমোতে সাদিয়ার সঙ্গে খাইরুল ইসলামের যোগাযোগ হয়। এরপর তার বাবা-মা ও পরিবারে কেউ বেঁচে নেই- এমন কথা শুনে দয়া হয় খাইরুলের। এ পরিপ্রেক্ষিতে খাইরুল তার প্রবাসী ভাই তরিকুলের সঙ্গে সাদিয়ার পরিচয় করিয়ে দেন। এভাবে দুই ভাইয়ের সঙ্গে কথা চলতে থাকে সাদিয়ার। এক পর্যায়ে সাদিয়া কক্সবাজার থেকে নিজ ইচ্ছায় ঝিনাইদহে খাইরুলের বাসায় চলে আসেন এবং তাকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। বিয়ের ১০ থেকে ১২ দিন পর সাদিয়া খাইরুলকে জানান, তিনি খাইরুলের ভাই তরিকুলকে ভালোবাসেন।
সাদিয়ার প্রথম স্বামী মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘সাদিয়ার সঙ্গে ইমোতে আমার যোগাযোগ প্রায় দুই বছর আগে। কিছুদিন কথা বলার পর সে আমাকে জানায়, তার মা-বাবা মারা গেছেন। তার পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। বিষয়টি আমি আমার প্রবাসী ভাই তরিকুলকে জানাই। আমার ভাই এরপর থেকে মোবাইলে সাদিয়ার সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। মেয়ের কেউ না থাকায় এখানে আসতে বলে। সে নিজের ইচ্ছায় এখানে আসে এবং আমি বিয়ে করি।’
আরও পড়ুন
রোহিঙ্গাদের এনআইডি পাওয়া ঠেকানোর কৌশলের খোঁজে ইসি
ভোটার হতে গিয়ে নির্বাচন অফিস থেকে ৪ রোহিঙ্গা গ্রেফতার
খাইরুল বলেন, ‘বিয়ের ১০ থেকে ১২ দিন পর সাদিয়া আমাকে জানায় যে, সে আমার ভাই তরিকুলকে ভালোবাসে। এরপর একদিন রাতে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এবং আমাকে তালাকনামা পাঠায়। আমি তাতে স্বাক্ষর করে দিই। পরবর্তী সময়ে সাদিয়া আমার ভাইয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে বিয়ে করে। বিয়ের চার মাস পর সাদিয়া আমার ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে আবার আমাদের বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করে এবং এখানে ভোটার হয়।’
খাইরুল আরও বলেন, সাদিয়া যা বলেছে তাতে তার বাড়ি কক্সবাজার জেলার কলাতলী নামক জায়গায়।
যেভাবে রোহিঙ্গা হিসেবে ধরা পড়েন সাদিয়া
খাইরুলের সঙ্গে বিয়ের এক মাস ১৮ দিন পর শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে যান সাদিয়া। পরে তিনি খাইরুলকে তালাকনামা পাঠান। খাইরুল তাতে স্বাক্ষর করে দেন। এরপর মোবাইলে প্রবাসে থাকা তরিকুল ইসলামকে বিয়ে করে চার মাস পর আবার শ্বশুর বাড়িতে এসে উঠেন তিনি। কিছুদিন পর শ্বশুর বাড়িতে শুরু করেন ঝগড়া-বিবাদ। এক পর্যায়ে বেরিয়ে যান শ্বশুর বাড়ি থেকে। সেখান থেকে তিনি চলে যান বগুড়ায়। পরে বগুড়ার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যান পাসপোর্ট করতে। তাকে দেখে ও কথা শুনে অফিসের কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। এতে তারা নির্বাচন কমিশনকে সাদিয়ার এনআইডি তদন্তের অনুরোধ জানায়।
ইসির তদন্ত প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, গত ১০ আগস্ট বগুড়ার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা টেলিফোনে জানান, সাদিয়া ফাহা নামের নারী একজন রোহিঙ্গা। তিনি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। মহেশপুর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে তদন্তের জন্য বলেন।
নির্বাচন কমিশনের তদন্তে উঠে আসে- অভিযুক্ত ভোটার সাদিয়া ফাহা স্বামী- মো. তরিকুল ইসলাম, পিতা- মৃত রায়হান, মাতা- মৃত রাবিয়া ভোটার তালিকা হালনাগাদ-২০২৫ এ নতুন অন্তর্ভুক্ত হন। এ বিষয়ে তদন্তকালে আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রে বিদ্যমান স্বামী মো. তরিকুল ইসলামের মাতা, ছোট ভাইসহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সাদিয়া ফাহার শাশুড়ি বলেন, অভিযুক্তের মুখে শুনেছি তার বাড়ি কক্সবাজারের দিকে, পিতা-মাতার বিষয়ে কিছুই আমরা জানি না বা চিনি না। তদন্তে আরও জানা যায়, সাদিয়া ফাহা বর্তমান স্বামী মো. তরিকুল ইসলামের ছোট ভাই মো. খাইরুলকে প্রথমে বিয়ে করেন। পরে মো. তরিকুল ইসলামের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে মো. তরিকুল ইসলামের ছোট ভাই মো. খাইরুল ইসলাম বিষয়টি জানতে পারেন এবং তাকে তালাক দেন। পরে প্রবাসী মো. তরিকুল ইসলামের সাথে পুনরায় মোবাইলে বিবাহ করেন। বর্তমানে মো. তরিকুল ইসলাম মালায়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। এই সূত্র ধরে সাদিয়া ফাহা হালনাগাদ-২০২৫ এ নাটিমা ইউনিয়ন পরিষদে এসে ভোটার হন।
ইসির প্রতিবেদন বলা হয়, অভিযুক্ত সাদিয়া ফাহা ঢাকায় অবস্থান করছেন। সাদিয়া ফাহার শাশুড়ি বলেন, আমাদের এলাকায় ভোটার হোক, এটা আমরা চাই না। শাশুড়ি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের মতে, যেহেতু তথ্য গোপন করে অন্য কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ভোটার হয়েছেন সেহেতু আমরা ধারণা করছি সে রোহিঙ্গা। এছাড়া তদন্ত কর্মকর্তার কাছেও সাদিয়া ফাহা যে একজন রোহিঙ্গা তা প্রমাণ হয়েছে।
সাদিয়া ফাহা যে ফোন নাম্বার ব্যবহার করে ভোটার হয়েছেন সে নাম্বারে একাধিকবার ফোন করে করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে ইতোমধ্যে নানা কৌশল গ্রহণ করেছে ইসি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে বিশেষ এলাকাগুলোতে কঠোর তৎপরতার পাশাপাশি প্রতারণা করে কেউ ভোটার হলে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
আরও পড়ুন
কক্সবাজারে কত রোহিঙ্গা নাগরিক ও ভোটার, তদন্ত চেয়ে রিট
ইসিকে রোহিঙ্গাদের ডাটাবেজ দিতে সম্মত ইউএনএইচসিআর
কমিশনার বলেন, বিভাগীয় থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কমিটি রয়েছে ইসির। সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে না পারে, সেজন্য ‘বিশেষ’ এলাকার ৫৬ উপজেলায় নিয়মিত তালিকা হালনাগাদ করা হয়।
জানা যায়, বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলের নাগরিকদের এনআইডি সেবা সহজ করতে এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) কার্যক্রমে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত ঠেকাতে তিনটি ক্যাটাগরিতে নাগরিকদের আবেদন ভাগ করে নিয়ে নিষ্পত্তি করে থাকে সংস্থাটি। কেউ আবেদন করলে প্রথমে ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ফেলার কথা বলা হয়েছে। দুটি ক্যাটাগরির কোনোটিতেই না চিহ্নিত করা না গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদন ‘সি’ ক্যাটাগরি বা বিশেষ কমিটির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে। আবার কেউ আবেদন করলেই যেন রোহিঙ্গা সন্দেহ না করা হয়, সেই নির্দেশনাও দেওয়া হয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে থেকে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, যাদের এসএসসি/সমমান বা তদূর্ধ্ব সনদ আছে এবং পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সঙ্গে তথ্যের মিল থাকবে তারাই ‘এ’ ক্যাটাগরিতে পড়বেন। আবার এসএসসি/সমমান বা তদূর্ধ্ব সনদ থাকবে না কিন্তু অনলাইন জন্ম সনদ ও পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সঙ্গে তথ্যের মিল থাকবে তারা ‘বি’ ক্যাটাগরিতে পড়বেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যেসব আবেদনে সন্দেহ হবে সে আবেদনগুলো ‘সি' ক্যাটাগরি বা বিশেষ কমিটির কাছে চলে যাবে।
এমএইচএইচ/জেবি