আবুল কাশেম
২৫ জুন ২০২২, ০৯:০৬ এএম
সালটা সঠিক মনে পড়ছে না। তবে ২০১০-১১ হবে সম্ভবত। সেজো মামার বিদেশ যাওয়ার জন্য স্থানীয় এক এজেন্টকে সব টাকা পয়সা দেয়া শেষ। হঠাৎ করে একদিন বিকেলে ওই এজেন্ট জানালেন কাল ভোরেই ফ্লাইট। আমি তখন ঢাকা থেকে বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমি, বড় মামা ও সেজো মামা সন্ধ্যায়ই রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। যশোর থেকে বাসে উঠলাম। সঠিক সময়ে পৌঁছতে পারব কি না তা নিয়ে রাজ্যের চিন্তা। তবে ভরসা ছিল পাটুরিয়া দৌলতদিয়া ঘাটে যদি জ্যাম না থাকে তাহলে হয়তো পৌঁছাতে পারবো।
সবকিছু ভালোই ছিল। কিন্তু রাত এগারোটার দিকে ঘাটে পৌঁছে দেখা গেল বাস যেখানে আছে সেখান থেকে ফেরি পার হতে সকাল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এত দূরে গাড়ি কী করা যাবে। ওদিকে এজেন্ট ফোন দিয়ে বলছেন যে সাড়ে তিনটার মধ্যে এয়ারপোর্টে থাকতে থাকবে।
কোনো উপায় না পেয়ে আমরা গাড়ি থেকে নেমে ঘাটের দিকে হাঁটতে থাকলাম। প্রায় দুই কিলোমিটার মতো হেঁটে লঞ্চে পার হলাম পদ্মা। তারপর ঢাকামুখী একটি বাসে কোনোমতে উঠলাম। কোনো সিট খালি না থাকায় পুরো পথ দাঁড়িয়ে ঢাকায় আসতে হলো। অল্প কথায় লিখলেও সে এক অসহায় ও দুর্বিসহ যাত্রা। যদিও সময়ের মধ্যে পৌঁছলেও এই যাত্রায় আসলে মামার বিমানের ফ্লাইট ছিল না। এজেন্ট একটা ধাপ্পা দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে অবশ্য অন্য আরেক দেশে গিয়েছিলেন মামা।
২০০৯ সালে একা একা কিছু টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম পড়তে। তারপর থেকে প্রতিটি যাত্রাই সারাপথ ভালোভাবে যাওয়া আসা করলেও ঘাটের কাছে গেলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত। কখনো জ্যাম, আবার কখনো বড় ব্যাগ টানার কষ্ট। প্রতিটি যাত্রাতেই এই কষ্ট ছিল সঙ্গী।
যশোর-ঢাকার মধ্যে মোটামুটি ৫-৬ ঘণ্টায় ভ্রমণ করা যায়। কিন্তু এমনও হয়েছে যে, যশোর থেকে রওনা দেয়ার পর ২৪ ঘণ্টা পর ঢাকায় পৌঁছেছি। যারা কখনো রোগী নিয়ে বা জরুরি প্রয়োজনে এই পথ পাড়ি দিয়েছেন তারা জানেন একটি সেতুর মূল্য কতখানি।
ঢাকায় আসার পর পথের বিষয়ে একটু পরিচিত হওয়ার পর নিয়মিত বাড়ি যাই এবং ফিরি মাওয়া ঘাট দিয়ে। প্রমত্তা পদ্মা যে কতটা ভয়ংকর তা যারা এই পথের নিয়মিত যাত্রী তারা অবলোকন করেছেন। পদ্মার ভয়ংকর রূপের একটা দৃশ্য বোঝাতে আরেক যাত্রার কথা স্মরণ করতে পারি। বর্ষাকালে বাড়ি থেকে ফিরছি। একটু দ্রুত সময়ের মধ্যে মাওয়ার অপর প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে। এখন পদ্মা পার হতে হবে। তাড়া থাকায় উঠলাম স্পিডবোটে। তখন পদ্মা সেতুর বিষয়ে কথা হচ্ছে কিন্তু কোনো কাজ শুরু হয়নি। পুরনো ঘাটে সাধারণত স্পিডবোটে পার হতে ২০ মিনিট মতো লাগতো। এর মধ্যে ১২ মিনিট মতো লাগতো মূল পদ্মায় আসার আগেই। আর মূল পদ্মা পার হতে ৭-৮ মিনিট লাগতো। কিন্তু সেদিন এমন ঢেউ আর উত্তাল ছিল যে মূল পদ্মাটুকুই পার হতে লেগেছিল ৩০ মিনিট মতো। সবার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ছিল। স্পিডবোট খুব দ্রুত ও পানির ওপর ভেসে চলে। তারপরও সেদিন পুরো শক্তি দিয়েও সেটি যতটুকু সামনে যাচ্ছিল তার চেয়ে পেছনে যাচ্ছিল বেশি। এই দৃশ্যর সঙ্গে বাস্তবের পদ্মাসেতু তুলনা করলে সেটা স্বপ্নের চেয়েও বড় কিছু।
গত রমজানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই আব্দুর রহমানের সঙ্গে মোটরসাইকেলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভোরে রওনা দিলাম যাতে দুপুরের আগেই বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায়। তবে বাধ সাঁধলো সেই ফেরিঘাট। ঘাটে গিয়ে দেখলাম কোনো ফেরি নাই। সম্ভবত সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ঘাটে অপেক্ষা করতে হয়েছে। অথচ এই সময়ের মধ্যে আল্লাহ চাইলে আমরা প্রায় বাড়িতেই পৌঁছে যেতে পারতাম।
প্রায় ১৩ বছরের ঢাকার জীবনে প্রতিটি যাত্রায়ই দুর্ভোগের আরেক নাম ছিল ফেরিঘাট। যখন পদ্মাসেতুর কাজ শুরু হয়নি। তখন এই পথের প্রতিটি যাত্রীই ফেরিঘাটে গেলে স্বপ্ন দেখতেন যে, যদি প্রমত্তা পদ্মায় কোনোদিন একটি সেতু হতো। তারপর যখন বাধাবিপত্তি পার করে কাজ শুরু হলো তখন তাদের অপেক্ষা ছিল কবে শেষ হবে এর কাজ। আর এখন তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিয়েছে।
সংসদে বিএনপির গুটিকয়েক সদস্য রয়েছেন তাদের দুই একজনের কথা শুনেছি। তাদের কথা ভালো লেগেছে। তারা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে পদ্মা সেতু অবশ্যই বড় একটি অর্জন। তারা এই সেতুর অর্জন অস্বীকার করেননি। বরং তারা দুর্নীতির কথা তুলেছেন, এটি তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
পদ্মা সেতু নির্মাণে কত টাকা ব্যয় হয়েছে, কোথায় দুর্নীতি হয়েছে, সেটির সত্যতা কতটুকু- এসব নিয়ে বহু বিতর্ক হতে পারে। সমালোচনা হতে পারে। সরকার চাইলে এই ঘটনার বাস্তবতা কতটুকু তা জানতে সুষ্ঠু তদন্তও হতে পারে। তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে পদ্মা সেতু শুধু স্বপ্ন নয়, স্বপ্নের চেয়েও বড় কিছু।
একে