বোরহান উদ্দিন
২৪ জুন ২০২২, ০৩:২২ পিএম
এক যুগ আগে মাওয়া ঘাটের কাছাকাছি ৬০ হাজার টাকায় সাত শতক জমি কিনেছিলেন তোতা খান। রাস্তাসহ নানা সমস্যার কারণে সেখানে কোনো স্থাপনা করতে পারেননি। পরবর্তীতে পুরো জমিটাই পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণ করা হয়।
৬০ হাজার টাকার জমির জন্য পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে জন্ম নেওয়া তোতাকে দেওয়া হয় ১৬ লাখ। পাশাপাশি কুমারভোগের পদ্মা সেতু পুনর্বাসন কেন্দ্রে দেওয়া হয় সাড়ে সাত শতাংশের প্লট। সরকারের দেওয়া সেই জমিতে পাকা ঘর করে পরিবার নিয়ে অনেকটা আয়েশি জীবনযাপন করছেন তিনি।
শুধু তোতা খানই নয়, পদ্মার দুই পাড়ে মোট সাতটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে করা হয়েছে। যেগুলোতে তিন হাজারের বেশি পরিবার আয়েশি জীবনযাপন করছেন। তারা যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন তাকে রাজধানীর অভিজাত এলাকার সঙ্গে তুলনা করছেন কেউ কেউ।
বুধবার দুপুরে কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রের মসজিদ থেকে জোহরের নামাজ আদায়ের পর ঢাকা মেইলের মুখোমুখি হন তোতা খান।
কেমন আছেন জানতে চাইতেই অনেকটা কথা কেড়ে নিয়ে হাসিমুখে বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে অনেক শান্তিতে আছি। ঢাকার ভিআইপি এলাকায় যারা থাকে তারা তো গরম, রাস্তায় শব্দ কত সমস্যায় থাকে। এই জায়গায় যেদিক চোখ দেবেন খালি শান্তি। এত গাছপালা, রাস্তা, পানির লাইন আর কই পাবেন?’
এ সময় তার পাশে দাঁড়ানো আরেকজন বলেন, প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় যেসব সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় এই জায়গায় তার থেকে কম তো নয় বরং বেশি আছে।
আরেক মুসল্লি শরিফ হোসেন। যার ৫ শতাংশ জমি পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে নগদ অর্থ ও প্লট পেয়ে তিনিও এখানে পাকা ঘর করে থাকছেন।
তবে বাপ দাদার জমি সেতুর জন্য দিলেও কোনো আফসোস নেই এই ব্যবসায়ীর। বরং তার কাছে বিষয়টি গর্বের বলে মনে হয়।
ঢাকা মেইলকে শরিফ হোসেন বলেন, ‘জমি গেছে, বদলে জমি টাকা সব পাইছি। কোনো দুঃখ নেই। আমাদের জমি চলে গেলেও এর ওপর দিয়ে ব্রিজ হইছে। লাখ লাখ মানুষ ব্রিজের ওপর দিয়ে যাবে। এর চেয়ে শান্তির কি আছে?’
আজকের রাত পোহালেই উদ্বোধন হচ্ছে যাচ্ছে প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এই আয়োজনকে ঘিরে সারাদেশের মানুষের মধ্যে যখন বাড়তি উম্মাদনা তখন সেতুতে জমি দেওয়া মানুষগুলোও গাড়ি চলাচল করতে দেখার অপেক্ষায়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয় ২০০৬ সাল থেকেই। আর জমি অধিগ্রহণ শুরু হয় ২০০৯ সালে। সেতু প্রকল্পের অধীনে ২ হাজার ৬৮৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকই মাদারীপুর জেলায় পড়েছে। বাকিটা মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুরে। আর জমি অধিগ্রহণের পেছনে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৪১ কোটি টাকা।
প্রকল্প সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তৈরি করা সাতটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের মধ্যে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে চারটি এবং শরীয়তপুরের জাজিরার পূর্ব নাওডোবায় ৪ নম্বর, পশ্চিম নাওডোবার মাঝিরকান্দিতে ৬ নম্বর ও মাদারীপুরের বাকরেরকান্দিতে রয়েছে ৫ নম্বর পুনর্বাসন কেন্দ্র।
মাওয়া প্রান্তের চারটির মধ্যে কুমারভোগে ৩ ও ৭ নম্বর কেন্দ্র এবং মেদিনীমণ্ডলের যশলদিয়ায় ২ ও ৮ নম্বরটি। তাছাড়া লৌহজংয়ের দোগাছিতে রয়েছে ১ নম্বর পুনর্বাসন কেন্দ্র। এটি অবশ্য সাধারণ বাসিন্দাদের জন্য নয়। এটি পদ্মা সেতুতে কাজ করা চীনা প্রকৌশলীসহ অন্য কর্মকর্তাদের জন্য। পদ্মা সেতুতে জমি দাতাদের দেওয়া হয়েছে আড়াই, পাঁচ ও সাড়ে সাত শতাংশ করে প্লট।
সাতটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে বর্তমানে ৩০১১টি পরিবার বসবাস করছে। রয়েছে পাঁচটি স্কুল ও পাঁচটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এছাড়া সাতটি নান্দনিক মসজিদ ও খেলার মাঠও আছে।
পুনর্বাসন কেন্দ্রের ভেতরের হালহকিকত
সবগুলো কেন্দ্রের ভেতর একই ধরণের করা হয়েছে। প্লট পেয়ে যে যার মতো নির্মাণ করেছেন ঘরবাড়ি। ১২ ফুটের রাস্তা করা হয়েছে। প্রতিটি প্লটের মালিকরা দুইদিকে রাস্তা পেয়েছেন। অনেকগুলো বহুতল ভবনও হয়েছে ভেতরে। ফলে পদ্মাতীরের জনপদের এসব মানুষের জীবনমান পুরোপুরি বদলে গেছে।
মাওয়া প্রান্তের একাধিক কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বিষয় এখানকার গাছগাছালির সবুজের সমাহার। বন বিভাগ থেকে এখানে প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে। বিশেষ করে আম, পেয়ারা, জামরুলসহ নানা প্রজাতির ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। প্রতিটি রাস্তার দুই ধারে শুধু গাছ আর গাছ। যার প্লটের সামনে যে গাছ পড়েছে সেটার ফল তারা ভোগ করছেন।
এছাড়া প্রতিটি পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালিত হয় সুশৃঙ্খলভাবে। এখানকার বাসিন্দারা নির্বাচনের মাধ্যমে একজন সভাপতি নির্বাচন করেন। ওই সভাপতির নেতৃত্বে একটি পরিচালনা কমিটি আছে। কেন্দ্রগুলোর ভালো-মন্দ সবকিছু দেখভাল করে এই কমিটি।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পুনর্বাসন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী রজব আলী বলেন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেই সাতটি পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটিই কেন্দ্রের সবকিছু দেখভাল করছে।
কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রের (২) এর সহ-সভাপতি জামাল হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা সবাই মিলেমিশে আছি। সরকারের পক্ষ থেকে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে সেজন্য সবাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। নিজেদের স্বপ্নের জমি স্বপ্নের পদ্মা সেতুর জন্য ব্যবহার হচ্ছে এর চেয়ে বড় পাওয়া কিছু নেই।’
জানা গেছে, এই প্রকল্পের কারণে ১৫ হাজার ৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রায় সাড়ে আট হাজার কৃষক পরিবার। সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৮৬ হাজার। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত পাঁচ হাজার পরিবার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়।
ভিটেমাটি হারানো প্রায় দুই হাজার পরিবার প্লট নিতে আগ্রহ দেখাননি। এ ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিজেদের জমিতে ভিটা তৈরি এবং বাড়ি করার জন্য তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেককেই ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন সহায়তা এবং ক্ষেত্র বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। অনেকেই পেয়েছেন আয়বর্ধক নানা প্রশিক্ষণ। এর বাইরে পুনর্বাসন এলাকায় দুই পারে চারটি বাজার তৈরি করা হয়েছে। এসব বাজারে ১০০টি বাণিজ্যিক প্লট আছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা পেয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই পাড়ের পাঁচটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০১৭ সালের ১মার্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম চালু হয়েছে। একই বছরের ২ এপ্রিল থেকে কেন্দ্রগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়।
বিদ্যালয়গুলোতে প্রধান শিক্ষক, শিক্ষকদের কক্ষসহ আটটি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার, উপ-মেডিকেল অফিসার, নার্স, ফার্মাসিস্টসহ নয়জন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় রয়েছে রিসোর্স ইন্টেগ্রেশন সেন্টার (রিক), সাবলম্বী সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (এসএসইউএস), সমাহার নামের এনজিও।
বিইউ/এমআর