images

জাতীয়

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান, কতটা দূর হলো বৈষম্য?

নিজস্ব প্রতিবেদক

০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৭:২৬ পিএম

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল একটি প্রজন্ম। আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে। সেই আন্দোলনই পাল্টে দিয়েছিল দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ক্ষমতায় আসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অনেকে আশাবাদী ছিলেন, এই পরিবর্তন বৈষম্য দূরীকরণে বড় পদক্ষেপ হবে। কিন্তু বাস্তবে পরিবর্তন কতটা হয়েছে সেটা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনিক কাঠামোতে তেমন কোনো আমূল পরিবর্তন আসেনি। ভিআইপি প্রটোকল, দুর্নীতি, তদবির, এমনকি বিভিন্ন সেবায় ভোগান্তির মাত্রাও আগের মতোই রয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়, আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেই এখন উঠেছে ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির অভিযোগ। অনেকেই অভিযোগ করছেন, ‘জুলাই’ এখন ‘মানি মেকিং মেশিনে’ পরিণত হয়েছে। এই আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখা নারীদের অবস্থানও খুব একটা বদলায়নি। নারী হোস্টেলে কিংবা সমাজে নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে রয়ে গেছে প্রশ্ন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন সরকার দৃঢ় অবস্থানে যায়নি। বরং পুরোনো স্বৈরশাসনের আদলেই চলছে শাসনযন্ত্র। যারা ক্ষমতায় এসেছে তারাও সেই পুরোনো পথেই হাঁটছে- এমনটা মনে করছেন অনেকে।

জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই সংগঠনের নেতারা বলছেন, এক বছর আগে তারা যখন রাস্তায় নামেন তখন তাদের একটাই লক্ষ্য ছিল- দেশ থেকে বৈষম্য দূর করা। একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। যার কারণে তারা বহু ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু এক বছর পরেও এখনো অনেক কিছু করার বাকি আছে।

Julay2
জুলাই আন্দোলনে ছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ। ছবি: সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে- ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি, দখলদারি সেগুলোকে তারা হালকাভাবে নিচ্ছেন না। অভিযোগের সত্যতা থাকলে অবশ্যই তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, তারা নিজেরাও নন। তবে পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। একটি যুগান্তকারী আন্দোলনের পর এক বছরে যদি কেউ আশ্বস্ত হন যে, রাতারাতি সব দুর্নীতি, বৈষম্য ও শোষণ মুছে যাবে, তাহলে সেটা বাস্তবতার বাইরে। দেশের কাঠামোগত সমস্যাগুলো অনেক গভীরে। চেষ্টা করা হচ্ছে ভেতর থেকে সেই কাঠামো ভাঙার, কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিরোধ প্রবল থাকার কারণে সম্ভব হয় না অনেক সময়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তরুণদের নেতৃত্বাধীন নতুন দল এনসিপির। তাদের মধ্যে এক শ্রেণির নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মব কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে সরকার ও এনসিপি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজ দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাদের ঐক্যও নষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থা আরও কিছুদিন চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈষম্য দূরীকরণ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কিন্তু নতুন নেতৃত্ব যে গতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বাস্তবে তার প্রতিফলন খুবই দুর্বল। প্রশাসনে শুদ্ধাচার বা ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং আগের মতোই তদবির, দুর্নীতি আর দলীয়করণে প্রশাসন আজও জর্জরিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, মানুষ যে আশা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, তা থমকে গেছে, পিছিয়ে গেছে। এখান থেকে ফিরে আসতে হলে নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যেতে হবে। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। ড. ইউনূস বা যেই হোক না কেন, তারা তো জনপ্রতিনিধি নন, নির্বাচিত কেউ নন। তাদের কেউই রাজনীতির ধারায় আসেননি, সে কারণে তারা এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

Julay3_2
বৈষম্য দূর করতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। ছবি: সংগৃহীত

তার মতে, গণতন্ত্র চর্চা থাকলে ধীরে ধীরে দুর্নীতিবাজরা ঝরে পড়বে। কেউ যদি দুর্নীতি বা খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে জনগণ ভবিষ্যতে তাকে আর ভোট দেবে না—এটাই গণতন্ত্র চর্চার সুফল। এখন আমার মনে হয়, আমাদের নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে হবে। তাহলেই এক সময় আমরা সঠিক পথে ফিরে আসতে পারব।

এই শিক্ষাবিদ বলেন, যারা এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, তারা সবাই ঠিক থাকতে পারেনি। অনেকেই তদবির, ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। যারা প্রকৃত শিক্ষার্থী ছিল, তারা ক্লাসে ফিরে গেছে, আর দুর্নীতিবাজ ও স্বার্থান্বেষীরা এখনো রয়ে গেছে। চারদিকে যেসব খবর শোনা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে চাঁদাবাজদের মহোৎসব চলছে। এভাবে চললে আসলে দেশের কোনো উন্নতি হবে না, বরং দেশ রসাতলে যাবে। আমরা যে প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম, তার কিছুই পূরণ হয়নি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র সিনথিয়া জাহান আয়েশা ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই কোটা আমাদের ওপর এক ধরনের বোঝা হয়ে চেপে বসেছিল। সেটার বিরোধিতা করতেই মূলত আমরা রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু এরপর আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি, চাকরির ক্ষেত্রে সেই কোটা এখনো রয়ে গেছে, এখনো তা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। শুধু কোটা নয়, সামগ্রিকভাবে যে সকল বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলাম, সেগুলোরও পূর্ণ সমাধান আমরা এখনো পাইনি। বাস্তবে বৈষম্য দূর হয়েছে এমনটা বলার সুযোগ নেই।

এএইচ/জেবি