images

জাতীয়

নেই কোনো কৃতিত্বের দাবি, ছিল শুধু সাহসের বিস্ফোরণ

মাহাবুল ইসলাম

০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৮:১৩ এএম

  • ‘not for credit, but for courage’
  • জুলাই একক নায়কত্বের গল্প নয়, এটি প্রজন্মের গল্প
  • আমরা আশাহত নই, স্বপ্ন দেখতে চাই

রাজশাহী শহরের আকাশ তখনও থমথমে। রাজধানী ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন ক্রমশই সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে শুরু করছে। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু কর্মসূচি শুরু হয়েছে। কিন্তু শহর যেন নির্বাক এক পাথর! এরমধ্যেই রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো শহরের ভেতরে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করলেও প্রকাশ্যে তা কঠিন হয়ে পড়ে। এরপর যখন রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা হয়েই গেলো তখন তারাও রাজপথে নামা শুরু করে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের হাতে গোনা কর্মীদের চেয়েও তাদের প্রত্যাশার বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।

বিজয়ের পরে রাজনৈতিক দলের ও সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও সামনে আসলেও বিজয়ের প্রথম প্রহরেই আন্দোলনের ক্রেডিট নেয়ার তর্ক-বিতর্ক থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অথচ চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্বে রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের কাছ থেকে এসেছে হুমকি-ধামকি। অনেকে নিজের ঘরেও থাকতে পারেননি। কিন্তু তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন কেন? কেন নেই কৃতিত্বের দাবি? অথচ তাদেরও তো ছিল রক্ত-ভেজা পথচলার স্মৃতি।

রাজশাহীর রাজপথের নিভৃতে ইতিহাস লিখেছেন অনেকেই। যাদের নাম পোস্টারে নেই, নাম নেই কমিটিতেও। তবুও ছিলেন লড়াইয়ের প্রতিটি রক্তাক্ত ধাপে, সাহসের ছায়াসঙ্গী হয়ে। সেইসব মুখহীন সৈনিকদের একজন রাজশাহীর তরুণ তোকি তাজয়ার। তখন তিনি রাজশাহীর সর্বস্তরের কোটাবিরোধী আন্দোলন গ্রুপের মডারেটর। আন্দোলনের বীজ রোপণ থেকে শুরু করে মিছিলের প্রতিটি বাঁকে তিনি ছিলেন সদা সক্রিয়। কখনও সামনে কখনও আড়ালে। জুলাইয়ের রক্তাক্ত মুহূর্তে যখন অনেকেই ঘুমিয়ে, তখন তিনি রাতভর অনলাইনে সংগঠিত করছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের। ১৬ জুলাই থেকে রাজশাহীর আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল সবার নজরে। কিন্তু খুব শিগগিরই বাস্তবতার নিষ্ঠুর ছায়া এসে পড়ে এই স্বপ্নমুখর আন্দোলনের গায়ে। ১৮ জুলাই ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় রক্তাক্ত হন রাজশাহীর বেশকিছু শিক্ষার্থী। সেই সময়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের কেউ আর একত্র হতে পারছিলেন না। চারপাশে ঘুরছিল ভয়, নির্যাতনের ছায়া। তবু তারা থেমে যাননি। শেষ অবধি, লড়ে গেছেন।

তোকি বলেন, আমি প্রতিটি মুহূর্তের লড়াইয়ে ছিলাম। রাজশাহীর রাজপথ তখন শুধু প্রতিবাদের ভাষা জানতো। আমি ছিলাম সেইসব মুখহীন সৈনিকদের একজন, যারা গলা উঁচিয়ে বলেছিল, এবার চুপ থাকব না। প্রতিদিন মিছিল করেছি, শুধু উপস্থিত থেকে নয়, আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি, তথ্য দিয়েছি, সিদ্ধান্তে সাহায্য করেছি। গুলি খাওয়া ভাইবোনদের হাসপাতালে নিতে, রক্তের ব্যবস্থা করতে, এমনকি নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য ছুটে বেড়িয়েছি শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি, অনেকের পরিবারের পাশে থেকেছি। ভয়হীন হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট সবার আগে দিয়ে সবার কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সত্যের পাশে দাঁড়িয়েছি। এই কারণেই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বেশ বড় একটা অংশ কয়েকবার আমার বাসায় এসেছে। তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে, এমনকি চেষ্টাও করেছে।

তিনি আরও বলেন, বেশ কয়েকবার টিয়ারশেলের আঘাতে পড়েছি। নিশ্বাস আটকে যাচ্ছিল, তবুও নিজের কথা ভাবিনি। পাশে থাকা ছোট ভাইবোন, আপুদের নিরাপদে সরিয়ে দিয়েছি। আমার রাজশাহীর আন্দোলনের প্রতিটি চিত্র আমার চোখের সামনে আঁকা। স্বপ্ন ছিল দেশটা বদলাবে। ভেবেছিলাম এই লড়াইয়ের পর মানুষ নিরাপদে কথা বলবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো রাজনৈতিক আগ্রাসন আজো টিকে আছে। এখনও অনেকে চায় আমরা চুপ থাকি। তবুও আমি গর্বিত, কারণ আমি ইতিহাসের এক গৌরবময় মুহূর্তে নীরব থাকিনি। আমি রাজপথে ছিলাম, দেশের জন্য, নিজের বিবেকের জন্য- ‘not for credit, but for courage’।

একই বেদনা বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন ইয়াসিন আলীও। সদ্য রাজশাহী কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করা এক সাহসী যুবক। জুলাইয়ের উত্তাল দিনে তিনি আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। রাজপথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের চিত্র দেখে বসে থাকতে পারেননি।

তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী রূপ আমি সামনে থেকে দেখেছি। আমাদের সামনে তখন দুটি রাস্তা— চুপ থাকা, অথবা নিজের অবস্থান জানানো। আমি দ্বিতীয় পথ বেছে নিয়েছিলাম। তবে আমরা তো কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত ও বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন দেখি, স্বপ্নগুলো পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে, তখন কষ্ট হয়। তবে ভালোলাগা এই যে, আমি ইতিহাসের গর্বিত অংশীদার। এই গল্প কোনো একক নায়কত্বের গল্প নয়। এটি একটি প্রজন্মের গল্প, যারা দেশের জন্য নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেনি।

রাজশাহীর আরেক কিশোর মুগ্ধ। জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারিতেই দেখা গেছে তাকে। তিনি বলেন, আমি কিছু সময়ে সরাসরি রাজপথে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি। বড় একটা সময় সংগত কারণেই অনলাইনে অ্যাক্টিভিজম করি। রাজশাহীর সে সময়ের সবচেয়ে বড় ও প্রসিদ্ধ গ্রুপ রাজশাহীর সর্বস্তরের কোটাবিরোধী আন্দোলন গ্রুপের মডারেটর ছিলাম। শেষ সময় অবধি দায়িত্ব পালন করেছি। ১৫ জুলাই রাতে আমরা রাজশাহীর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের একত্রিত করি অনলাইনে। উদ্দেশ্য ১৬ জুলাই একটি বড় আন্দোলন বের করা। তখন অবধি আমাদের ওপরে বড় কারো হাত ছিল না। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আমরা কয়জন সেটা নেতৃত্বও দিয়েছি। আমাদের কারোই কোন রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। ১৮ তারিখ আমাদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। আমাদের ভাই-বোনদের আহত করে। আমরা আন্দোলনের শেষের দিকে একত্রিত হতে পারছিলাম না। তবে একেবারে শেষ দিকে সবাই স্বেচ্ছায় রাজপথে নেমে আসে। ৫ আগস্টের আগে রাজশাহীতে কোনো মৃত্যু ঘটেনি। কিন্তু ৫ আগস্ট আমাদের বিজয়ের দিন একটি ভুল পদক্ষেপের জন্য দুইজন শহীদ হন। এখন অবশ্য এসব কথা বলা যায় না। কেননা আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করলেও কোনো কমিটির দিকে যাবার আগ্রহ কখনোই সেভাবে ছিল না। আমরা তো দেশের জন্য রাজপথে নেমেছিলাম।

আন্দোলনের প্রত্যাশা কিঞ্চিৎ বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র। অন্তবর্তীকালীন সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের মাঝে অবস্থানরত কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষদের জন্য দেশে বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। প্রতিটা জায়গায় গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব পরিচয়ে নানাবিধভাবে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা হচ্ছে। স্বার্থান্বেষী মহল এত সক্রিয় যে, যারা প্রকৃত দেশপ্রেম নিয়ে সংস্কার করতে চায় তারা গুরুত্ব পাচ্ছে না। প্রত্যাশাগুলো অপূর্ণ। তবে এখনও সময় আছে, একত্রিতভাবে দেশকে এগিয়ে নেয়ার।

আরেক শিক্ষার্থী তাসফিয়া রিধি। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী বলেন, আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে ২৮ জুলাই দুপুরের দিকে আমাকে ডিবি পুলিশ তুলে নেয়। কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই। আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের সিক্রেট লোকেশনে। ওরা বারবার জানতে চায়— আমার পিছনে কে আছে? কে আমাদের নির্দেশ দিচ্ছে? আমি তখনও বলেছি, আজও বলি— আমি কারো আদেশে নামিনি রাস্তায়। আমি দেশের জন্য নেমেছি। দেশের ভবিষ্যতের জন্য, নিজের বিবেকের তাড়নায় নেমেছি।

তিনি আরও বলেন, ওরা আমার ফোন, ব্যাগ, জামা সব তল্লাশি করে। কিছু পায় না। কারণ আমি ইচ্ছা করে আমার কাছে কোনো প্রমাণ রাখিনি। আমি জানতাম, ধরা পড়লে এসবই আমাকে বিপদে ফেলবে। অনেক চাপের পরও ওরা শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তারপর আসে ৫ আগস্ট। আমরা সেই দিনটিকে বিজয় হিসেবে দেখেছিলাম। স্বৈরাচার হাসিনার পতন, এক নিপীড়নমূলক সময়ের অবসান। কিন্তু আজ এক বছর পর কিছুটা হতাশ হতেই হয়, কেননা আমরা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলাম; সেটা পাইনি। দুর্নীতি আগের মতোই আছে। চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক নাটক, নিরাপত্তাহীনতা— সব ঠিক আগের জায়গায়। রাজনৈতিক দলগুলো এখন শুধু কে গদি পাবে সেটা নিয়েই ব্যস্ত। এমনকি যারা জুলাই আন্দোলনের কোনো কাতারেই ছিলেন না তারা আজ দাবি করে তাদের জন্যই নাকি আমাদের বিজয়। আমি জানি, জুলাইয়ের স্পিরিট অনেকটাই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই থেমে গেছে। কিন্তু আমাদের থামলে চলবে না। আমি এখনও সেই বাংলাদেশ চাই, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচবে, সত্য বলবে ভয় ছাড়া, আর দেশের নেতৃত্ব আসবে জনগণের মনের প্রতিনিধি হয়ে।

এমআই/এফএ