নিজস্ব প্রতিবেদক
০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৪০ এএম
আজ ৫ আগস্ট ২০২৫। গেল বছর এই দিনে দেশে ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানে পতন ঘটে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসনের। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়েন এবং দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন।
শত শত প্রাণের বিনিময়ে আসা সেই বিজয় ‘নতুন বাংলাদেশে’র স্বপ্ন দেখিয়েছিল। দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হয়েছিল স্বাধীনতার, সমতা আর গণতন্ত্রের নতুন গল্প। কিন্তু এক বছর পর এসে সেই স্বপ্ন কতটা বাস্তব হয়েছে, সে প্রশ্ন এখন সামনে উঠে এসেছে।
৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে যেভাবে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে হামলা চালানো হয়েছিল, সেই গণহত্যার বিচার এখনো হয়নি। তখনকার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো ছিল—গুম, হত্যা, নিপীড়ন—তার জবাবদিহিতা এখনো অনুপস্থিত।
নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণকে যে নতুন শাসনব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটিও অনেকাংশে বাস্তবায়িত হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে সেই অঙ্গীকার ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে।
আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও সেটি কতটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে হবে, তা নিয়েও মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা ও সংশয়।
অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি ছিল ছাত্র-তরুণরা। কিন্তু তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কতটুকু পূরণ হয়েছে, তা নিয়েও হতাশা স্পষ্ট।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হলেও এখনো ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশিত হয়নি। সব দলের সম্মতিতে এই সনদ ঘোষণার কথা থাকলেও তাতে গতি নেই। সংস্কারের গতিও অনেক ধীর।
গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি। দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে নানা কর্মসূচি। বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই সনদ’ পাঠ করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আসিফ হাসান, এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ছিলেন আন্দোলনের প্রথম সারিতে। ছররা গুলিতে মুখে আটটি সেলাই পড়ে, এখনো পায়ে ব্যথা নিয়ে হাঁটেন। তিনি বলেন, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির জায়গায় অপ্রাপ্তিটাই বেশি। রাজপথে যারা জীবন দিয়েছে, তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি।
তিনি অভিযোগ করেন, আন্দোলনের সময় মানুষ দেশকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সেই ভালোবাসার অপমান করেছে।
ইয়ামিন হোসেন রাতুল, যিনি বাবা হারিয়েছেন ছোটবেলায়, জুলাই আন্দোলনের সময় ছিলেন সম্মুখভাগে। নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের হাতে আহত হন তিনি।
তিনি বলেন, আম্মুর ফোন ধরতাম না। উনি বলতেন বাসায় ফিরে আয়। আমি বলতাম, কাপুরুষ না আমি। আজ এক বছর পরেও বিচার হয়নি, জুলাই সনদ হয়নি। তাহলে আমরা কেন রাজপথে নামলাম?
২০২৪ সালের আন্দোলনে ‘কোটা না মেধা? মেধা, মেধা’ স্লোগান ছিল অন্যতম চালিকা শক্তি। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, চাকরিতে মেধাভিত্তিক সুযোগ নিশ্চিত করা।
কিন্তু এখনো বিসিএসসহ সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। সৌরভ কুমার সাহা, এক বিসিএস পরীক্ষার্থী বলেন, পিএসসি এখনো পুরনো নিয়মেই চলছে। শুধু গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমরা চেয়েছিলাম নতুন উদ্যোগ। কিন্তু পরিবর্তন শূন্য।
মানুষ যে রাজনীতির অপশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিল, সেই রাজনীতির সংস্কার এখনো দৃশ্যমান নয়। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মব কালচার এখনো মানুষকে আতঙ্কিত করে। নতুন দলগুলোও সাধারণ মানুষের ভাষা ধরতে পারছে না।
একজন জুলাইযোদ্ধা ও নতুন রাজনৈতিক দলের সদস্য বলেন, ফেসবুক বা ওয়াকিটকির কঠিন ভাষা জনগণের ভাষা না। জনগণ চায় সহজ কথা, সম্পর্কের কথা। আর সবচেয়ে খারাপ লাগে, যখন দেখি শিক্ষার্থীরাই চাঁদাবাজি করে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, যিনি জুলাই আন্দোলনের সময় সাহসিকতার সঙ্গে শেখ হাসিনার ছবি নামিয়ে আলোচনায় আসেন, বলছেন—কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, যেমন হলে হলে শিক্ষার্থীরা সিট পাচ্ছে। তবে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলেই মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, বৈষম্য এখনো আছে। নারীর নিরাপত্তা, মতপ্রকাশ, দৃষ্টিভঙ্গি—এসব পরিবর্তন হয়নি। তবে এখন কথা বলা যায়, এটা বড় অর্জন।
তার মতে, মানুষ যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার ফিরে পায়, তাহলে ধীরে ধীরে বৈষম্য দূর হবে। আমাদের আসল প্রত্যাশা, গণমানুষের রায়ে নির্বাচিত সরকার যেন বৈষম্য দূর করে।
এইউ