images

জাতীয়

অকুতোভয় জুলাইযোদ্ধা, সরকারি কর্মকর্তা হয়েও অসহযোগে সমর্থন

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

০৪ আগস্ট ২০২৫, ১০:৪০ পিএম

  • আন্দোলনে প্রকাশ্যে সমর্থন দেন নজরুল ইসলাম
  • ফ্যাসিস্ট টিকে গেলে চাকরিতে না ফেরার ঘোষণা
  • গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেও নেননি কোনো কৃতিত্ব
  • প্রয়োজনে আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের পর এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে সবাই যখন কৃতিত্ব ভাগাভাগিতে ব্যস্ত তখন নীরবেই কাজ করে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে প্রকাশ্যে একাত্মতা ঘোষণাকারী সরকারি কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম। অকুতোভয় এই জুলাইযোদ্ধা বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক (এডি)। আন্দোলনে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরও তাকে ক্রেডিট নিতে দেখা যায়নি। অনেকে সেভাবে তাকে চিনেও না। জুলাইকেন্দ্রিক কোনো অনুষ্ঠানেও তাকে আমন্ত্রণ জানাতে দেখা যায়নি। তবে তিনি নীরবেই আহতদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

২০২৪ সালের ২ আগস্ট নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ৩ আগস্ট সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও ৪ আগস্ট সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। ৩ আগস্ট সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল পালিত হলেও ৪ তারিখ অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দেননি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বরং উল্টো আন্দোলনকারীদের নাশকতাকারী আখ্যা দিয়ে তাদের বিপক্ষে মাঠে নামেন অনেক সরকারি কর্মকর্তা। তবে একজন মাত্র কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। ৩ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি আন্দোলনে সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং সেটা গণমাধ্যমেও জানান।

সেদিন ফেসবুকে তিনি লিখেন, ‘আমি মো. নজরুল ইসলাম সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি। দীর্ঘ ১৫ বছর চুপ থেকে এই সরকারের খুন, ব্যাংক লুট, দুর্নীতি সহ্য করেছি। কথা বলতে পারিনি। সম্প্রতি সাধারণ ছাত্র—ছাত্রীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা ও অনিয়মের কথা আমরা বলতে পারছি না— হৃদয় যেন আমাদের অন্ধ হয়ে গেছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত রাষ্ট্রের মালিক জনগণ তথা ছাত্রদের সঙ্গে থাকব, ইনশাআল্লাহ।’

সেদিন তিনি আরও লিখেন, ‘রাষ্ট্রের মালিক যদি জয়লাভ করে, তাহলে হয়তো আমি আবার রাষ্ট্রের মালিকের সেবা করতে ফিরে যাব। আর এই খুনি, ব্যাংক লুটেরা, দুর্নীতিবাজ সরকার যদি টিকে যায় তবে আমি হয়তো চাকরিতে ফিরব না।’

একই দিনে আরেক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘১৫ বছর তিন তিন বার অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানসিক শক্তি, মনোবল নষ্ট করে দিয়েছে। হৃদয় তাদের নিবু নিবু অবস্থা। কথা বলতে পারে না। এ সময় ইয়ং ছাত্র সমাজ জেগে উঠেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ত্রুটি তারা ধরতে পেরেছে। জীবন দিচ্ছে পরিবর্তনের জন্য। তাদের কাছে আমাদের শিখতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরা যদি না দাঁড়াই তাহলে তাদের রক্ত বৃথা যাবে। এটা হতে পারে না।’

অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে ঢাকা মেইলের কাছে অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম। অভ্যুত্থানের এক বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিষয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, 'নতুন স্বাধীনতার এক বছরে অবশ্যই অনেক প্রাপ্তি আমাদের যোগ হয়েছে। এখন মানুষ কথা বলতে পারছে, মত প্রকাশ করতে পারছে, স্বাধীনভাবে চলতে ফিরতে পারছে, এটাই সবথেকে বড় অর্জন।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের ব্যাংকের কথাই যদি বলি, বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে গ্রহণ করতে পারছে। যেটা আগে পারত না। আমাদের যে প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতি, সেটার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাইনি। যেমন ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, সেগুলো আমরা দেখতে পাইনি। বিশেষ করে যারা ১৫-১৬ বছর বিভিন্ন অনিয়মের জড়িত, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটা আমাদের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক। তাদের বিরুদ্ধে শুরুতেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।'

Nazrul2
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে রাজপথে ছিলেন নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

চলমান সংস্কার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, 'গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রের যে ক্ষত তৈরি হয়েছে এতে অনেক সংস্কার দরকার এবং সেটা সময়সাপেক্ষ। সেই সমস্যা সমাধানে কিছুটা সময়ক্ষেপণ হয়েছে। সেই সময়টা যদি সুচিন্তিতভাবে নেওয়া হতো তবে অনেক ভালো করা সম্ভব ছিল। এখন যেভাবে চলছে তাতে আমি আশা করছি সামনের পরিস্থিতি আরও উন্নতি হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সবার আন্তরিক ও প্রচেষ্টা থাকতে হবে।'

নজরুল ইসলাম বলেন, 'সংস্কার যদি জনগণের স্বার্থে হয় তবে মানুষ সেটা স্বাভাবিকভাবেই নেবে। এবং সরকারকে সেটা দৃঢ়তার সাথে করতে হবে। মৌলিক যে সংস্কার সেগুলো বর্তমান সরকারকে করে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। মানুষ যেন সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আর যেগুলো সংস্কার সময়সাপেক্ষ ব্যাপার সেগুলো পরবর্তী সারকার এসে করবে, এটাই আমার প্রত্যাশা।'

রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আমাদের সবাইকে সহনশীল হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আর যেন কোনো স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। ঐক্য ধরে রাখলেই আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত হবে। এছাড়াও আমাদের সহযোগিতা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা অব্যাহত রাখতে হবে।'

শহীদ পরিবারগুলোর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, 'শহীদদের কারণে আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক রেগুলেটরি বডি হিসেবে শহীদ পরিবারগুলোকে অনুদান দিয়েছে এবং দিচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে গভর্নরের সাথে কথা বলেছিলাম। গভর্নর এটার ব্যবস্থা করেছেন।'

এই জুলাইযোদ্ধা বলেন, ‘শেষে একটা কথা বলতে চাই, 'শহীদরা যে উদ্দেশ্যে জীবন দিয়েছেন সেটা যেন ব্যাহত না হয়। আবার যেন কোনো স্বৈরাচার জন্ম না নেয়। আল্লাহ না করুক, আবারও যদি তেমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে আবারও আমি আমার জায়গা থেকে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখব। আবারও স্বৈরশাসক এলে আগের মতোই তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেব। দেশের জন্য আজীবন কাজ করে যাব।'

টিএই/জেবি