images

জাতীয়

জুলাই আন্দোলনে সাহস যোগানো একজন সায়মা ফেরদৌস

বোরহান উদ্দিন

০৪ আগস্ট ২০২৫, ১০:৩৭ পিএম

ইতিহাসের মোড় ঘোরানো ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনে যখন প্রতিদিন রক্তে রঞ্জিত হচ্ছিল রাজপথ, তখন রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ। নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশের মাধ্যমে শাহবাগ থানা থেকে ঢাবি শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে নেওয়া, গুলি-টিয়ারশেলের মধ্যেও শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন অনেক শিক্ষক। যাদের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের শিক্ষক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস। জুলাই আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকার জন্য তিনি বেশ আলোচিত হয়েছেন এবং দেশে-বিদেশে পরিচিতি পেয়েছেন।

তৎকালীন সরকারের আন্দোলন দমনে বলপ্রয়োগ, গুলি চালানো নিয়ে অনেক শিক্ষক ছিলেন নিশ্চুপ। কিন্তু সায়মা ফেরদৌসদের মতো অনেকেই ঘরে বসে থাকতে পারেননি। নেমে পড়েন রাজপথে। জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়েন ঢাবির এই শিক্ষক। সায়মা ফেরদৌসের হৃদয় নিংড়ানো সেই বক্তব্য তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে। ‘অভিশাপে আসমান কাঁপে, আপনাদের কাঁপে না’, ‘আমাদের টাকায় কেনা গুলিতে আমাদের সন্তানকে বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে’, ‘একটা মারবেন দশটা আসবো, দশটা মারবেন লক্ষ আসবো’- তার এমন জ্বালাময়ী বক্তব্য সেদিন আন্দোলনের গতি বদলাতে বিরাট ভূমিকা রাখে।

শহীদ মিনারে সেদিন কী বলেছিলেন ড. সায়মা?

আন্দোলনের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাড়তে থাকে দমন-পীড়ন। প্রতিদিন তাজা প্রাণ ঝরতে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে। তবু পিছু হটেননি আন্দোলনকারীরা। বরং দিনে দিনে বাড়তে থাকে উপস্থিতি।

আন্দোলনের মাঝে একদিন শাহবাগ থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তা এক শিক্ষার্থীর মুখ চেপে ধরেন। যা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। গত বছরের ১৭ জুলাই ড. সায়মাসহ কয়েকজন শিক্ষক শাহবাগ থানা থেকে ছাড়িয়ে আনেন ঢাবির দুই শিক্ষার্থীকে। যা আন্দোলনকারীদের মাঝে সাহস জোগায়।

এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন ড. সায়মা ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘গুলি যাদের লেগেছে সেসব শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের আর্তনাদে আসমান কাঁপে। আপনাদের কাঁপে না, ওনার (শেখ হাসিনা) কাঁপে না? অভিশাপের ভয় হয় না? বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে আমার সন্তানদের। আমাদের টাকায় কেনা বুলেট ছোঁড়া হচ্ছে আমাদের সন্তানদের বুকে। কী জবাব দেবেন?’

ঢাবির এই শিক্ষক বলেন, ‘আর কত? পুলিশদের বলবো, আপনাদের বেতন হয় জনগণের টাকায়। তাদের (পুলিশ) ঘরেও সন্তান আছে। তারাও খোলসের মধ্যে একজন মানুষ। কী বলবেন সন্তানদের? একটা মারবেন, দশটা আসবো। দশটা মারবেন, লক্ষ আসবো। সারাদেশের মানুষ, মা-বাবা সবাই আসবে।’

আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ওদের মা-বাবা সন্তানদের পড়ালেখার জন্য পাঠায়। আমরা ওদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারি নাই। ওদের কাছে হাত জোর করে তাই ক্ষমা চাই।’

DD
জনপ্রিয় শিক্ষক ড. সায়মা ফেরদৌস। ছবি: সংগৃহীত

দেখতে দেখতে বছর পার হয়ে গেছে শেখ হাসিনার পতনের। ৩৬ জুলাইয়ের (৫ আগস্ট) বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজন হচ্ছে দেশে। স্বৈরাচার সরকারের পতনের এই দিনে পাঠ করা হচ্ছে, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র।’

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সায়মা ফেরদৌস ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ভয় ছিল। রাতে ঘুম হতো না। পরিবারকে আর দেখতে না পাওয়ার আশঙ্কা। আয়নাঘরের বাস্তবতাকে বরণ করে নেওয়া। কিন্তু এরচেয়ে বেশি তাড়িত করে সেটা হলো প্রতিবাদ করতে না পারা। এই আত্মদগ্ধতা প্রতিটা সেকেন্ডে তিলে তিলে মারছিল আমাদের।’

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) এই সদস্য বলেন, ‘আমার বাচ্চার বয়সী একেকটা ছেলে, তাদের একেকজনের মাথায়, মেরুদণ্ডে একেকটা বুলেট। এটা কোনোদিন বের হবে না। দুই চোখে গুলি। একটাতে অপারেশন হয়েছে, আরেকটা চোখ বের হয়ে আছে। পা-টা ভাঙা আছে। সেখানে শিকল বাঁধা। এমন অবস্থায় শিক্ষক হিসেবে আমাদের ঘরে বসে থাকা বেশি অনৈতিক, অন্যায় হতো। বের না হলে ভবিষ্যতে ক্লাসরুমে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস পেতাম না।’

শাহবাগ থানা থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্ত করে আনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেটা ছিল আমাদের মুক্তির আনন্দ। প্রতিবাদ করতে পারছি। ওদের পাশে দাঁড়িয়েছি। সেটা ছিল খোলা আকাশ। ওই মুহূর্তে আমাদের মাঠে নামার সুযোগটা শেকল ভাঙার আনন্দ ছিল। সর্বোপরি আন্দোলনের সময় একতার সুর ছিল সবার মধ্যে। ভিক্ষুকও তার টাকা দিয়ে আমাদের জন্য খাবার কিনে দিয়েছে। রিকশাওয়ালারা জীবনের তোয়াক্কা না করে অলিগলি দিয়ে আমাদের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিয়েছে।’

জুলাই আন্দোলনের এক বছর না পেরোতেই বিভেদের সুর নিয়ে তিনি বলেন, ‘একটা অন্যায় ঘটনা ঘটেছে। তার পেছনের মূল যে ক্রিমিনাল তাকে না খুঁজে দলীয় গালাগালি, তিরস্কারে লিপ্ত হওয়া কাম্য নয়।’

বিইউ/জেবি