মাহাবুল ইসলাম
০৪ আগস্ট ২০২৫, ১০:৩৪ পিএম
‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি আর না ফিরি, কষ্ট পেও না। শুধু গর্বিত থেকো। আমি চেষ্টা করেছি, মানুষ হতে।’ ছোট্ট এই চিঠিটি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকালে হাতে পেয়েছিলেন আনাসের মা।
কিন্তু সন্ধ্যা নামার আগেই, চানখাঁরপুলের গলিতে লাল হয়ে ওঠে অসফল বিপ্লবীর সাদা জামা। শাহরিয়ার খান আনাস, দশম শ্রেণির ছাত্র। পকেটে জাতির ভবিষ্যৎ, বুকভরা স্বপ্ন। আর সেই বুকেই বিঁধে যায় রাষ্ট্রের গুলি।
আনাসের মৃত্যু ছিল না কেবল একটি প্রাণহানির খবর, তা ছিল ভবিষ্যতের ওপর ছোড়া নির্দয় বুলেট। তার চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমাদের ভাইয়েরা কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে নেমেছে রাজপথে। একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, সাত বছরের শিশু, ল্যাংড়া মানুষও নেমেছে। আমি কীভাবে চুপ করে ঘরে বসে থাকি মা?’
আনাস চলে গিয়েছিল। ফিরে আসেনি। কিন্তু রেখে গিয়েছে নতুন বাংলাদেশ।
সেই জুলাইয়ের দিনগুলোতে, ঢাকা ছিল এক ধূসর মিছিল। যেখানে বাতাসে ঘুরে বেড়াত আতঙ্ক, আর মাটিতে জমা হতো রক্ত। এই শহরের রাস্তায় কাঁধে ব্যাগ ছিল না সেদিন, ছিল ছোট ছোট হাতে ধরা পতাকা। বুকভরা সাহস নিয়ে এসেছিল শিশুরা-কারও হাত ধরে নয়, অন্তর থেকে ডেকে ওঠা চেতনায়।
১৯ জুলাই, সন্ধ্যা। মোহাম্মদপুরে বারো বছরের রাকিব হাসান আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। হেলিকপ্টার নামের লৌহদানবটা মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছিল বারবার। এক সময় ছুটে আসে সাউন্ড গ্রেনেড। বিস্ফোরণের শব্দে থেমে যায় তার শ্বাসপ্রবাহ। রক্তে ভিজে যায় তার জামার কলার। সে আর বড় হবে না।
শহীদদের তালিকায় সবচেয়ে ছোটটি ছিল আবদুল আহাদ। বয়স মাত্র চার। পুতুল নিয়ে খেলার কথা ছিল তার, কিন্তু রায়েরবাগের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটি হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের এক অনিচ্ছাকৃত প্রতীক। বুকে গুলি। হাসপাতালের আইসিইউ। শেষ নিঃশ্বাসে বাবা বলেছিল, ‘আহাদ, চোখ মেলো…।’কিন্তু সে চোখ খোলে না আর।
মিরপুরে সাফকাত সামির (১০), উত্তরায় নাঈমা সুলতানা (১৫), নারায়ণগঞ্জে রিয়া গোপ (৬)। তারা কেউ মিছিলে যায়নি। তারা গিয়েছিল জানালার ধারে দাঁড়াতে, বারান্দায় বই পড়তে কিংবা নরম বিকেলের আলোয় খেলতে। কেউ আন্দোলনকারীদের তৃষ্ণা মেটাতে সামান্য পানির বোতল দিতে। তাদের অপরাধ-তারা বেঁচেছিল গণবিক্ষোভের ভেতর।
তাদের মৃত্যুও ছিল নীরব, অথচ সন্ত্রস্ত শহরের সবচাইতে করুণ কাব্য।
শহীদ নাইমা সুলতানার মা মোসা. আইনুন নাহার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার মেয়েটা অনেক মেধাবী আর স্বপ্নবাজ ছিল। ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি, মেয়েকে এভাবে হারাতে হবে। ঘাতকের গুলি আমার ঘরে থাকা মেয়েটাকেও নিয়ে গেল। এর বিচার চাই।’
যাদের নাম ঠাঁই পায়নি রেজিস্টারে
পথশিশু। জুলাই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে তাদের নাম যেন ভুলতে বসেছে সবাই। অথচ প্রতিরোধের প্রথম প্রহরের নির্ভীক সৈনিক ছিল তারাই। রাজপথে সেদিন কেবল শহরের ছেলেমেয়েরা ছিল না। ছিল ছিন্নমূল, নামহীন, বেওয়ারিশ শিশুরাও।

যাদের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না, যাদের পোশাক নেই, স্কুল নেই, নাম লেখা নেই কোনো খাতায়। তবু তারা এসেছিল। শিশু হয়ে নয়, নাগরিক হয়ে। স্বপ্ন না দেখেও, স্বপ্ন বাঁচাতে।
একটি গবেষণা বলছে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ১৬৮ জন পথশিশু নিহত হয়েছে। ৫০৬ শিশুর চোখে লেগেছিল ছররা, গুলি বা দগদগে বারুদের আঘাত।
৪৩ জন শিশুকে কারওয়াবাজার থেকে আটক করা হয়, যাদের দেহে ছিল নির্যাতনের দাগ। ৭২ শতাংশ পথশিশু সহিংসতার মুখে পড়ে, ১৩ শতাংশ গুলিবিদ্ধ হয়।
গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় তাদের নাম নেই, কিন্তু রাষ্ট্রের বন্দুক তাদের দেহকে চিনেছে ঠিকই। তারা ছিল না রাজনৈতিক কর্মী, ছিল না কোনো সংগঠনের ব্যানারে। তাদের একমাত্র পরিচয়-তারা মানুষ ছিল, প্রতিবাদ করেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শিশুরা যেভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তা একটি মনস্তাত্ত্বিক জাগরণের প্রতিচ্ছবি। তারা অন্যায় বুঝে না ঠিকই, কিন্তু ভালোর স্পর্শ তাদেরও স্পর্শ করে। যখন শিশুরা মিছিলে নামে, তখন সমাজের স্থবিরতা ভাঙে, বড়রাও সাহস পান।’
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘রাষ্ট্রের উচিত এসব শহীদ শিশুর স্মরণে স্থায়ী উদ্যোগ নেওয়া। বিশেষ করে পথশিশুদের, যাদের কেউ খোঁজ নেয় না, অথচ তারাও ইতিহাস গড়েছে। রাষ্ট্রের দায় রয়েছে, পথশিশুদের অবদানগুলোর স্বীকৃতি দেওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রের যে উদ্যোগ তাতে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারছি না। যে ধরনের নীরবতা দেখছি, তা গভীর হতাশাজনক।’
জুলাইয়ের সেই ভোরগুলোতে, অনেক মা দরজা খুলে অপেক্ষা করেছিলেন, ছেলেটা ফিরবে বলে। কেউ ফিরেনি। তারা ফিরবে না কোনো দিন। তবু কোনো কোনো রাতের নিস্তব্ধতায়, হয়তো ভেসে আসে এক কিশোর কণ্ঠ, ‘মা, আমি মিছিলে গেছি... তুমি গর্বিত হও... আমি মানুষ হতে চেয়েছিলাম।’ইতিহাস তাদের নাম হয়তো শেখাবে না পরীক্ষায়, কিন্তু একদিন, হয়তো একটি শিশু ক্লাসে দাঁড়িয়ে বলবে- ‘আমরা স্বাধীন হয়েছি কারণ আনাস বুক পেতে দিয়েছিল।’
এমআই/জেবি