images

জাতীয়

পদ্মা সেতু: কর্মসংস্থান বাড়বে খুলনায়

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

২২ জুন ২০২২, ১০:০০ পিএম

মাত্র দু’দিন পরই খুলে দেওয়া হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দিন বদলের স্বপ্ন বুনছেন আশপাশের জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষ। নানা শ্রেণি-পেশার এসব মানুষের সঙ্গে স্বপ্ন বুনছে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের মানুষও। তাদের মতে- পদ্মা সেতু তাদের জন্য শুধু আশীর্বাদই নয়, বরং নতুনভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগাবে এই সেতু। কারণ, এই সেতুর ফলে খুলনায় লাখো মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ফলে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবেন তারা।

ইতোমধ্যে খুলনার অনেক পরিবহন মালিক ঢাকা-খুলনা রুটে নতুন করে উন্নতমানের যাত্রীসেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন। কেউ কেউ আবার গড়ে তুলছেন নতুন নতুন কারখানা। যেখানে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে। এতে একসময়ে যেখানে খুলনায় শিল্পকারখানা থাকলেও তা বন্ধের উপক্রম হয়ে পড়েছিল, সেখানে এখন পদ্মা সেতু হওয়ায় নতুন করে কলকারখানার চাকা ঘুরবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে তৈরি হবে শিল্পায়নের নতুন ক্ষেত্র।

Padma Bridge

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর কারণেই বিভাগীয় শহর খুলনার সুখ্যাতি ছিল শিল্পনগরী হিসেবে। সোনালি আঁশের সেই বুনন বন্ধ হয়েছে। প্রায় দুই বছর আগে থেমে গেছে সব পাটকলের চাকা। এতে বেকার হয়েছেন কমপক্ষে ৬০ হাজার মানুষ। কাগজ, বোর্ড কিংবা ম্যাচ ফ্যাক্টরি শিল্পও যেন ‘ইতিহাস’ হয়ে পড়েছে খুলনায়। এছাড়া রূপসা তীরের চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা এলাকাতেও আগের সেই গতি নেই। বন্ধ হয়েছে অনেক ফ্যাক্টরি।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রামের সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামানের জেলাব্যাপী ছোট-বড় ২৬টি কল-কারখানা ছিল। দুই লাখের অধিক শ্রমিক এসব কারখানায় কাজ করতেন। একে একে সব কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে শ্রমিকরা জীবিকার তাগিদে অন্যত্র চলে যাওয়ায় খুলনা শহরের জনসংখ্যাও কমে আসছে। তবে বর্তমানে পদ্মা সেতুকে ঘিরে আবারও আশায় বুক বাঁধছেন শিল্প নগরীর ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন- সেতু চালুর পর নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটবে এই অঞ্চলে।

ইতোমধ্যেই খুলনা জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর ফলে মোংলা বন্দর, ভোমরা ও বেনাপোল স্থলবন্দরের কেন্দ্র হবে খুলনা। তিনি আরও বলেছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এই জেলায় নতুন করে উন্নয়নের মাত্রা যুক্ত হবে। নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হবে। নতুন করে আবার এই খুলনা শহর জেগে উঠবে।

Padma Bridge

এদিকে, অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরাও বলছেন- পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি প্রায় চার কোটি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাবে প্রত্যক্ষভাবে।

অন্যদিকে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ‘দ্বি-খণ্ডিত বাংলাদেশ’ সড়কপথে ঐক্যবদ্ধ হবে। এই সেতু সড়ক ও রেলপথের যোগাযোগের মাধ্যমে তড়িৎ অগ্রগতি আনবে। পণ্য পরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা শাস্ত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। সেই সঙ্গে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী শিল্পপতিদেরও ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এছাড়া ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ও হযরত খানজাহান আলী (রা.) মাজার, ষাট গম্বুজ মসজিদ ঘিরে পর্যটনের ব্যাপক প্রসারও ঘটবে।

ইতোমধ্যে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে আজ আন্তর্জাতিক সকল সংস্থা সাহায্য-সহযোগিতার হাত আরও জোরদার করেছে। জাতির জনকের কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টা আর দৃঢ়তার ফলে পদ্মা সেতু আজ বাস্তবে রূপ নেওয়ায় কুয়াকাটা, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট- সুন্দরবন, ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ ও হযরত খানজাহান আলী (রা.)-র মাজারসহ পর্যটনের ব্যাপক উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে।

এ বিষয়ে খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, মোংলা থেকে শুরু করে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জের আশপাশের প্রচুর জায়গা দেশি-বিদেশি শিল্পপতিরা কিনে ফেলেছে। পদ্মা সেতু হওয়ায় এখানেও আমরা আশার আলো দেখছি যে, এ অঞ্চলে ব্যাপক হারে ইন্ডাস্ট্রি হবে। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানও বাড়বে।

Padma Bridge

খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মো. মফিদুল ইসলাম টুটুল এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার দুই কোটি মানুষের আঞ্চলিক বৈষম্য কমবে। সেই সঙ্গে সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। পাশাপাশি নতুন শিল্প কল-কারখানা স্থাপন হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব বাড়বে। এছাড়া ভোমরা, দর্শনা, বেনাপোল বন্দরসহ ভারতের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও গতি আসবে।

মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, পদ্মা নদীর ওপরে শুধু একটি সেতু নয়। পদ্মা সেতুর সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জড়িত। বহু দিক থেকে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতার মাইলফলক, আর তার কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

খুলনা বাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নগর শাখার সভাপতি শ্যামল হালদার বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এই সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য আরও ত্বরান্বিত হবে। অর্থনীতির চাকা সচল হবে। পাশাপাশি মোংলা বন্দরের গতি বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে খুলনায় পণ্য আনতে যে খরচ হয় তা-ও অনেকটা কমে আসবে। ফলে ব্যবসায়ীদেরও সাশ্রয় হবে। আবার ক্রেতারাও কম মূল্যে পণ্যসামগ্রী কিনতে পারবেন।

Padma Bridge

শ্যামল হালদার বলেন, পদ্মা সেতু খুলনাবাসীসহ এই অঞ্চলের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এই সেতুর ফলে মানুষের চলাচল সহজ হবে। অল্প সময়ের মধ্যে খুলনা থেকে ঢাকায় পৌঁছানো যাবে। এছাড়া পদ্মা সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে শিল্প প্রতিষ্ঠান। এতে লাখ-লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছেন তার যোগ্য উত্তরসূরি এবং সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘায়ু কামনা করেন। পাশাপাশি সরকার নির্ধারিত টোল কমানোরও দাবি করেন তিনি।

এদিকে, খুলনার সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও ব্যবসায়ী নেতা আবদুল গাফফার বিশ্বাস বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অনেক দিনের প্রত্যাশা ছিল, সেটি বাস্তবায়ন হলো। তবে তিনি পদ্মা সেতু চালুর পাশাপাশি খুলনায় বন্ধ হওয়া কল-কারখানাগুলো চালুর দাবি জানিয়ে বলেন, তাহলে পূর্ণতা পাবে দক্ষিণাঞ্চল। যদিও এই সেতু ঢাকাকে খুলনার কাছাকাছি নিয়ে যাবে। ব্যবসায়ীসহ মানুষের শ্রমঘণ্টা বেঁচে যাবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না ফেরির জন্য। সেই সঙ্গে পণ্যবাহী ট্রাক-পরিবহন অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে।

Padma Bridge

পদ্মা সেতুর ফলে দ্রুত মালামাল দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর সুফল অর্থনীতিতে পড়বে। মানুষের দুই দিনের কাজ একদিনে শেষ হবে। কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হবে। তবে প্রাথমিকভাবে সেতুর টোল একটু বেশি হয়েছে। টোল আরও সহনীয় করলে ভালো হতো। এ জন্য খুলনা-ঢাকা পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করি- যাত্রীদের সাধ্যের মধ্যেই ভাড়া নির্ধারণ হবে।

সার্বিক বিষয়ে খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মূর্শেদী বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানী থেকে খুলনা যাতায়াতে তিন ঘণ্টা সময় কম লাগবে। অর্থাৎ মাত্র চার ঘণ্টায় খুলনা থেকে রাজধানীতে পৌঁছানো যাবে। এছাড়া সেতুটি চালু হলে চট্টগ্রামের তুলনায় মোংলা থেকে রাজধানীতে কম সময়ে এবং কম খরচে পণ্য পৌঁছানো যাবে, তাই মোংলা বন্দরের কর্মব্যস্ততাও বেড়ে যাবে।

পদ্মা সেতুর ফলে খুলনায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হতে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি হবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। সবমিলে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে অনেক বেশি। কারণ, মোংলা বন্দরের কর্মকাণ্ড বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষেরই কর্মসংস্থান হবে। আবার অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলেও লাখো মানুষের কর্মসংস্থান হবে। পাশাপাশি সেতুর কারণে স্থানীয় উৎপাদনকারীরাও প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবেন। যেমন: এই অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়িসহ অন্যান্য পণ্য ছাড়াও কৃষিপণ্য সেতু দিয়ে স্বল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারবে। এখন যেমন ফেরিতে দীর্ঘসময় পড়ে থাকতে হয়, তাতে কাঁচামাল পচে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে পদ্মা সেতু চালু হলে এসব ঝুঁকি আর থাকবে না।

ডব্লিউএইচ/আইএইচ