মোস্তফা ইমরুল কায়েস
২৩ জুলাই ২০২৫, ১০:২২ পিএম
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ ও চিকিৎসাধীন শিশুদের নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে অভিভাবকদের। বেশির ভাগ শিশুর পোড়ার ক্ষত অনেক বেশি। এসব পোড়া যখন শুকাবে তখন টান পড়বে। এমন দগ্ধ রোগীদের বাঁচানো বেশ কঠিন। এজন্য ভুক্তভোগী পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের জন্য দেশবাসীর কাছে বারবার দোয়া চাচ্ছে। প্রিয় সন্তানকে বাঁচাতে কেউ কেউ নফল নামাজ পড়ছেন, মহান আল্লাহর দরবারে প্রাণভিক্ষা চাইছেন।
বুধবার (২৩ জুলাই) আরও একজনের মৃত্যুর খবর এসেছে। এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ জনে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, মৃতের সংখ্যা ২৯। শুরু থেকেই মৃতের সংখ্যা নিয়ে দুই ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এতে জনমনে দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি। কেউ কেউ মরদেহ লুকিয়ে ফেলার অভিযোগও তুলছেন। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমন কোনো সুযোগ নেই।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর-আইএসপিআর ঘটনার দিন সোমবার জানিয়েছিল, এ ঘটনায় ১৭১ জন আহত হয়েছে। তবে এর একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় চলে গেছেন। বাকিদের একটা বড় অংশ এখন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।
বিশেষায়িত এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের সবশেষ তথ্য বুধবার বিকেলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন। তিনি জানিয়েছেন, এখানে চিকিৎসাধীন ৪৪ জনের মধ্যে আটজনের অবস্থা ক্রিটিক্যাল। মানে খুব বেশি ভালো না। তাদের বাঁচামরা এখন পুরোটাই ওপরওয়ালার হাতে। তবে চিকিৎসারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাতে প্রতিটি আক্রান্ত শিশু সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। তাদের চিকিৎসায় মঙ্গলবার রাতে সিঙ্গাপুর থেকে একজন চিকিৎসক ও দুইজন নার্স ঢাকায় এসেছেন। সেই চিকিৎসক নানা পরামর্শ দিচ্ছেন।
মাইলস্টোনের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী দগ্ধ সামিয়ার বাবা আব্দুর রহিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার মেয়ের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। যদিও তার শরীরের পোড়ার অংশ মাত্র ২৫ শতাংশ বলেছেন ডাক্তার। কিন্তু সে কথা বলতে পারছে না। আমার মেয়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন। সে যেন সুস্থ হয়ে ওঠে।’
‘বাবা হিসেবে এ দৃশ্য দেখার মতো না’
সেদিন স্কুল ছুটির পর বাসায় ফেরার জন্য অপেক্ষায় ছিল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিয়া হক। কিন্তু আর ফিরতে পারেনি। এখন দগ্ধ তাসনিয়া হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার বাবা মো. হাফিজ উদ্দিন বলেন, পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ। মেয়েটার হাত-পা-মুখসহ সব পুড়ে গেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্বাসনালী। ডাক্তার বলেছেন, ৪৮ ঘণ্টা না গেলে কিছুই বোঝা যাবে না। এ অবস্থায় মেয়েকে কী বলে সান্ত্বনা দেবো!
হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘সে কথা বলতে পারছে না। কাছে গেলে পোড়া হাতের দিকে তাকিয়ে আঙুল নাড়ানোর চেষ্টা করে। ইশারায় শরীরের যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা করে, অপলক তাকিয়ে থাকে। একটু নড়তেও পারছে না। বাবা হিসেবে এ দৃশ্য দেখার মতো না।’
শুধু সামিয়ার বাবা আব্দুর রহিম ও তাসনিয়ার বাবা হাফিজই নন, তাদের মতো অন্য অভিভাবকরাও দেশবাসীর কাছে দোয়া চাচ্ছেন। তারা আশাবাদী, তাদের সন্তানরা সুস্থ হয়ে ফিরবে। আবারও পড়াশোনায় মনোনিবেশ করবে।
দগ্ধ মাহতাবুরের প্রশ্ন- আমি বাঁচব কি না!
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে যারা চিকিৎসাধীন বেশির ভাগই শিশু। এদের আটজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। রাখা হয়েছে আইসিইউতে। বাকিদের অবস্থারও তেমন উন্নতি নেই। ফলে সেই অভিভাকরাও উদ্বেগ ও শঙ্কায় আছেন।
হাসপাতালটির আইসিইউতে ভর্তি রয়েছে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহতাবুর রহমান ভূঁইয়া। তার বড় বোন নাবিলা জানান, মাহতাবুর পানীয় জাতীয় কিছু খেতে চাচ্ছে। গতকাল তাকে জুস দেওয়া হয়েছিল। তবে মাহতাবুরের প্রশ্ন, সে বাঁচবে কি না!
আতঙ্কে ঘুম হচ্ছে না মুনতাহার
অন্যদের সঙ্গে পুড়েছে ১০ বছরের শিশু মুনতাহা তোয়া কর্ন। তার শরীরের মাত্র ৫ শতাংশ পুড়েছে। কিন্তু তার মাঝে এখানো সেই দিনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারছে না সে।
কর্নর বাবা আবুল কালাম আজাদের তিন সন্তান। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। একমাত্র মেয়ে কর্ন। বড় ছেলে প্রাণন একই স্কুল থেকে এবার এসএসসি পাস করেছে।
তিনি বলেন, যেখানে বিমান পড়েছে, ওই স্থানের পাশেই দাঁড়িয়েছিল মুনতাহা। বিমান পড়ার সাথে সাথে অন্যদিকে দৌড় দেয় সে। খুব ভয় পেয়েছে আমার মেয়েটা। সারারাতে ঘুমাতেও পারেনি।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানিয়েছে, তাদের সন্তানরা খুবই যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগই পোড়ার যন্ত্রণায় কথা বলতে পারছে না। তবে কেউ হাতের ইশারায় কথা বলছে। আবারও কেউ মাঝে মাঝে বলছে, যন্ত্রণা আর নিতে পারছে না।
হাসপাাতালটিতে কেউ কেউ আইসিইউ ও অন্যান্য ওয়ার্ডে প্রিয় সন্তানের জন্য বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কেউ তাসবিহ হাতে নিয়ে চোখের পানি ফেলছেন। তারা চান, দেশবাসীর দোয়ায় তাদের প্রিয় সন্তান যেন আবার ফিরে আসে পড়ার টেবিলে।
এমআইকে/জেবি