ঢাকা মেইল ডেস্ক
২১ জুলাই ২০২৫, ১০:৪৬ পিএম
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ঘটনায় বিমানটির পাইলট ও স্কুলের শিক্ষার্থীসহ কমপক্ষে ২০ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১৭১ জন।
জানা যায়, বিমানটি প্রথমে মাঠে আছড়ে পড়ে। পরে এটি ৩০ গজ গর্ত করে সামনে এগিয়ে যায়। এটি প্রতিষ্ঠানটির দুই তলা বিশিষ্ট একটি ভবনের নিচতলায় গিয়ে আঘাত করে। বিমানটি নিচতলার একটি কক্ষে ঢুকে যায়। ঘটনাটি ঘটে স্কুল ছুটির ঠিক আগ মুহূর্তে।
‘আগুন ধরা প্লেনটা আমার চোখের সামনেই বিল্ডিংয়ে আঘাত করছে’ —ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারহান হাসান।
সোমবার (২১ জুলাই) ফারহান হাসানের একটি পরীক্ষা ছিল। বেলা ১টায় পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। এমন সময় হঠাৎ করেই বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি তাদের সামনে আছড়ে পড়ে।
হাসান বলেন, ‘আমার একটা বেস্ট ফ্রেন্ড, যে পরীক্ষার হলে একসঙ্গে ছিল, আমার চোখের সামনেই মারা গেছে।’
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘স্কুল ছুটি হবে হবে —এমন সময় বিমানটা সরাসরি জুনিয়র সেকশনের বিল্ডিংয়ে আঘাত করে, যেখানে নার্সারি, ওয়ান, টু, থ্রি- এসব শ্রেণির ক্লাস হয়। বিল্ডিংয়ের গেটে একেবারে গর্ত হয়ে আগুন ধরে যায়।’

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই ঘটনার কিছু ভিডিওতেও স্কুলের বাগান সংলগ্ন একটি ভবনের নীচতলায় বিধ্বস্ত বিমানের ইঞ্জিনে আগুন জ্বলার দৃশ্য দেখা যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। একইসঙ্গে চলতে থাকে উদ্ধার তৎপরতা।
এ ঘটনায় বিমানটির পাইলট ও স্কুলের শিক্ষার্থীসহ কমপক্ষে ২০ জন নিহত হয়েছেন। হতাহতদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্কুলের শিক্ষার্থী হাসান বলেন, ‘স্কুল গেটের ভেতরে অনেকগুলো গার্ডিয়ান দাঁড়ায়ে ছিল, আর ছোটরা বের হচ্ছিল ছুটির টাইমে। তখন গার্ডিয়ানদেরসহ প্লেনটা নিয়ে গেছে।’
এদিকে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ অনেককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাদের বেশিরভাগই শিশু শিক্ষার্থী।
এ ঘটনার মঙ্গলবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। ঘটনাটি কীভাবে ঘটল, সেটি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।

বিমানটি সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
উত্তরায় যে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে সেটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই মডেলের যুদ্ধবিমান বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর)।
বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইসফাক ইলাহী চৌধুরী জানান, বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি মূলত প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে।
চীনে তৈরি এফ-৭ মডেলের বিমানগুলো প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ব্যবহার করে আসছে বলেও জানান তিনি।
ঘটনার পর এক বিবৃতিতে আইএসপিআর জানিয়েছে যে, নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার দুপুর একটা ছয় মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বিমান বাহিনী ঘাঁটি থেকে বিমানটি উড্ডয়ন করে।

বিমানটি চালাচ্ছিলেন বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম। উড্ডয়নের মিনিট দশেকের মধ্যেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয় বলে জানা যাচ্ছে।
ঘটনাটি কীভাবে ঘটল, সরকার সেটি খতিয়ে দেখবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা খুবই শোকাহত। সরকার ইতোমধ্যেই মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। একইসঙ্গে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাটি কীভাবে ঘটলো, সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।’
এদিকে, ঘটনার পর প্রকাশিত বিবৃতিতে আইএসপিআর দাবি করেছে যে, উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর বিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। এ বিষয়ে তদন্তের পরে বিস্তারিত জানানো হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
আইএসপিআর বলছে, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উক্ত বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজ এর দোতালা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে।
ঘটনা কারণ উদঘাটনে ইতোমধ্যে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে একটি ‘উচ্চ পর্যায়ের’ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে আইএসপিআর।

হাসপাতালে ছবি হাতে স্বজনরা
উত্তরার বিভিন্ন হাসপাতাল স্বজনদের ভিড় ঘুরে দেখা যায়। তাদের মধ্যে অনেকে এসেছে আহতদের সঙ্গে, কেউ কেউ এসেছেন স্বজনদের খুঁজতে। সন্তানের খোঁজে অনেকে ছবি নিয়ে ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে।
আহতদের জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে অনেকে স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে হাসপাতালে এসেছেন।
মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর অনেকেই স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিলেন। তারা জানিয়েছেন, ওই স্কুল থেকে আহতদের উদ্ধার করে শুরুতেই এই আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের বেশিরভাগের শরীরের নানা অংশ পুড়ে গিয়েছে।
আহত বা দগ্ধ অবস্থায় যাদের আনা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগের বয়স ছিল ১০ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে বলে জানিয়েছেন এক চিকিৎসক।
কোন হাসপাতালে কতজন ভর্তি?
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় রাজধানী ঢাকার কোন হাসপাতালে কতজনকে আহত অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে অথবা মৃতদেহ রয়েছে, তার একটি তালিকা দিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর।

সেই তালিকা অনুযায়ী, আহতদের মধ্যে জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে ৭০ জন, সিএমএইচে আহত ১৪ জন, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে আহত ৮ জন এবং উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে ১১ জন ভর্তি রয়েছেন। এছাড়া উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে আহত ৬০ জন এবং উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে আহত এক জন নিয়ে সর্বমোট ১৬৪ জন আহত অবস্থায় ভর্তি রয়েছেন।
এছাড়া নিহতদের মরদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
এ দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় শনাক্ত করা যাবে, তাদের মৃতদেহ দ্রুত পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যাদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা যাবে না, তাদের মৃতদেহ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করে পরবর্তীতে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এমএইচটি