মো. মেহেদী হাসান হাসিব
২১ জুলাই ২০২৫, ০৮:০৮ এএম
আওয়ামী লীগের শাসনামলের বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন ছিল চরম বিতর্কিত। একতরফা ও জালিয়াতির এসব নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের বৈধতা নেওয়া হয়েছিল মাত্র। এই নির্বাচনগুলোতে ছিল না জনসমর্থন। এসব নির্বাচন আয়োজনে বড় ভূমিকা ছিল ওই সময়ের নির্বাচন কমিশনসহ ভোটগ্রহণের সঙ্গে জড়িত সকল কর্মকর্তাদের। তাই এবার বিগত তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসারদের বিস্তারিত তথ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে চেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
জানা যায়, বিগত ওই তিন নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সঙ্গে জড়িত মোট কর্মকর্তা ছিল ১২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৪০ জন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করা হয় ১৪৭টি আসনে। এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ছিল মোট ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ জন। যার মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিল ৬৬ জন, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিল ৫৭৭ জন। প্রিজাইডিং অফিসার ছিল ১৮ হাজার ২০৮ জন, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ছিল ৯১ হাজার ২১৩ জন আর পোলিং অফিসার ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ৪২৬ জন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ছিল মোট ৬ লাখ ৮ হাজার ৫৮৪ জন। যার মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিল ৬৬ জন, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিল ৫৮২ জন। আর এদের অধীনে প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২ জন, আর পোলিং অফিসার ছিল ৪ লাখ ৬২৪ জন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ছিল মোট ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৬৬ জন। যার মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিল ৬৬ জন, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিল ৫৯২ জন। প্রিজাইডিং অফিসার ছিল ৪২ হাজার ১৪৮ জন, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ছিল ৮৪ হাজার ২৯৬ জন আর পোলিং অফিসার ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৪ জন।

ইসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, মামলার তদন্ত করার স্বার্থে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আমাদের কাছে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসারদের তথ্য চেয়েছে। আমরা সে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারসহ সকল জেলা প্রশাসককে কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি। তথ্য আসার পর তা আমরা পিবিআইকে দেব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ ঢাকা মেইলকে বলেন, বিগত ৩ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তার তথ্য চেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারসহ সকল জেলা প্রশাসককে ইসির পাঠানো এ সংক্রান্ত চিঠি উল্লেখ করা হয়েছে, ডিএমপি এর শেরেবাংলা নগর থানার, মামলা নং-১১, জি আর নং-১৫৬/২০২৫খ্রি, ধারা ১২০বি/১০৯/১৭১বি/১৭১ডি/১৭১জি/১৭১এইচ/১৭১আই/১২৪৩/৪০৬/৪২০ পেনাল কোড এর সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ঢাকা মেট্রো (উত্তর), ঢাকা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের নাম, ঠিকানা, পিতার নাম, মাতার নাম, স্থায়ী/বর্তমান ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট নম্বর ও মোবাইল নম্বর ভোটকেন্দ্র ভিত্তিক সরবরাহের জন্য অনুরোধ করেন।
এক্ষেত্রে এসব তথ্য জরুরি ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রেরণের জন্য বলা হয়েছে এ চিঠিতে।
এদিকে গত ২২ জুন দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তাঁর আমলের তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), ১০ জন নির্বাচন কমিশনারসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য (মামলা ও তথ্য সংরক্ষণ সমন্বয়ক) মো. সালাহ উদ্দিন খান মামলা করেন।
এর আগে, তিনি এসব নির্বাচনে ভোট পরিচালনাকারী সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি আবেদন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিনের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।
আবেদন জমা দেওয়ার পর সালাহ উদ্দিন খান বলেছিলেন, বিতর্কিত তিন নির্বাচনকে ঘিরে বারবার অভিযোগ করার পরেও তৎকালীন সিইসি ও সংশ্লিষ্টরা কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। আমরা আশা করি বর্তমান নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।
এরপর ওই দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর দুইদিন পর গত ২৫ জুন সকালে রাজধানীর মগবাজার থেকে সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। অসুস্থ থাকায় এখনও সাবেক সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার হতে হয়নি।

গত ১৬ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠক শেষে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া ‘বিতর্কিত’ তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
ওই সময় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সকল রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে যে, অতীতের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনে কর্মকর্তাদের ভূমিকা তদন্ত ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন।
জানা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান। সেই সংসদকে ‘বিনা ভোটের সংসদ’ আখ্যা দেয় ভোট বর্জন করে বিএনপি। কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন এ কমিশনে চার নির্বাচন কমিশনার ছিলেন- সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবু হাফিজ, সাবেক যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আব্দুল মোবারক, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাবেদ আলী এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা দায়রা জজ মো. শাহনেওয়াজ।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া ‘বিতর্কিত’ তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীরা মাত্র সাতটি আসনে জয় পায়। সে নির্বাচনের নাম হয় ‘রাতের ভোট’। কেএম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন এ কমিশনের সদস্য ছিলেন সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ কবিতা খানম ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারিতে বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে শরিক ও বিরোধীদল জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সঙ্গে দলের বিদ্রোহীদের। এ নির্বাচনের নাম হয় ‘ডামি’ নির্বাচন। কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন এ কমিশনে চার নির্বাচন কমিশনার ছিলেন— অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান।
এমএইচএইচ/এএস