নিজস্ব প্রতিবেদক
২০ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৬ পিএম
বছর ঘুরে আবার এসেছে জুলাই। তবে ২০২৪ সালের সেই জুলাই যেন অনেক পরিবারের ক্যালেন্ডারে আজীবনের শোকচিহ্ন হয়ে আছে। এই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে রাজপথ হয়েছিল রক্তের নদী, রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল তরুণ প্রাণ। কেউ চোখে গুলি খেয়ে চিরতরে নিথর হয়ে গিয়েছিল পুরান ঢাকার রাজপথে, কেউ রাজশাহীর আলুপট্টিতে বুকের মাঝে গুলি নিয়ে ছিটকে পড়েছিল মাটিতে। শহীদ নাদিমুল হাসান এলেম ও শহীদ সাকিব আনজুম— এই দুই নাম আজ আমাদের বিবেকের দরজায় বারবার কড়া নাড়ে।
ছেলেকে হারিয়েও অপেক্ষা করেন যে মা
নাদিমুল হাসান এলেমের মা ইসমাত আরা বেগম এখনও প্রতিদিন ছেলের হাত থেকে ওষুধ খাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকেন। ৪৮ বছর বয়সী এই হৃদরোগী মা বিশ্বাস করেন— তার আদরের ছেলেটা আবার ফিরে আসবে, ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে তাকে। অথচ বাস্তবতা বড় নির্মম।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে এলেম পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিতে বাসা থেকে বের হয়। প্রধান সড়কজুড়ে চলছিল প্রতিবাদী স্লোগান, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে দীপ্ত কণ্ঠে প্রতিবাদ। হঠাৎ গর্জে ওঠে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি। একটি গুলি এসে লাগে এলেমের চোখে। সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।
বাবা শাহ আলম স্মরণ করেন, এলেম খুব দায়িত্বশীল ছিল। মা’র ওষুধ কেনা থেকে শুরু করে সংসার চালানো— সব কিছুতেই সে সাহায্য করত। আমি বলতাম, এসব নিয়ে এত ভাবিস না। তখন বলত— সবাই যদি চুপ করে থাকে, তাহলে দেশটা এগোবে কীভাবে?
গোলাগুলির খবর শুনে ছুটে যায় পরিবার। মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, এলেম আর নেই। গুলির আঘাতে ছেলেকে চিনতেই কষ্ট হচ্ছিল তাদের। সাদা শার্ট পরা ছেলেটির গায়ে তখন শুধু রক্ত আর রক্ত, শার্টটা হয়ে গিয়েছিল লাল।
মরদেহ নিতে হলে পুলিশের ক্লিয়ারেন্স লাগে। পরিবারকে সুত্রাপুর, কোতোয়ালি, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও গেন্ডারিয়া থানায় ঘুরতে হয়। সর্বত্র তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। শেষ পর্যন্ত কালীগঞ্জে নিজ বাড়িতে মরদেহ নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু শোক প্রকাশেও বাধা আসে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা দ্রুত দাফনের চাপ দেয়। মনকি শুভাড্ডা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়, কেউ যেন কাঁদতে না পারে।
শাহ আলম বলেন, আমার স্ত্রী ওইদিন থেকেই অসুস্থ। আমার ছেলের মৃত্যু শুধু আমাদের পরিবার নয়, পুরো সমাজের জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি।
পরিবারটি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা এবং ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে ৫ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছে।
শাহ আলম কালীগঞ্জ তেলঘাট থেকে বয়েজ ক্লাব পর্যন্ত সড়কটি যেন নাদিমুল হাসান এলেমের নামে নামকরণ করার দাবি জানান।
সাকিব আনজুমের গল্প
রাজশাহীর রায়নগরের নিঃশব্দ ঘরে বসে কান্না চেপে রাখা এক মায়ের মুখে আজও প্রতিধ্বনিত হয় সেই দিনটির স্মৃতি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, রাজশাহীতে ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের যৌথ হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সাকিব আনজুম। রাজশাহীর আলুপট্টিতে তার নিথর দেহ পড়ে থাকে দীর্ঘ সময়। কেউ হাসপাতালে নিতে দেয়নি। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় লাশ ফেরত আনে ছোট ভাই।
সাকিব ছিলেন রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষার জন্য ফিনল্যান্ডে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন গুলির আঘাতে থেমে গেছে চিরতরে।
তার মা রোকেয়া খাতুন জানান, ওরা গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ওকে ঘিরে রেখেছিল। হাসপাতালে নিতে দেয়নি। এরপর লাশ নদীতে ফেলে দিতে চেয়েছিল। এক বাড়ির মালিক ও ছাত্রদের কারণে আমরা লাশটা ফিরে পেয়েছি।
সাকিবের বাবা মাইনুল হক বলেন, আমার ছেলের খুনিরা এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। গ্রেফতার হয় না। আমি বিচার চাই— শুধু ছেলের নয়, এই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
সাকিবের ছোট দুই ভাই কলেজে পড়ে। তারা এখনও বুঝে উঠতে পারে না— সেই ভাই, যিনি ঘর সামলাতেন, তাদের পাশে দাঁড়াতেন; তিনি আর নেই।
এমআই/এফএ