নিজস্ব প্রতিবেদক
১৮ জুলাই ২০২৫, ০৬:২৫ পিএম
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার গয়লা গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দিনমজুর মো. আব্দুল লতিফ। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে শহরের এলিয়ট ব্রিজ এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে শহীদ হন তিনি।
সেদিন সিরাজগঞ্জ শহরের এসএস রোড থেকে মিছিলটি শুরু হয়। ধীরে ধীরে জনসমাগম বাড়তে থাকে। পরে মিছিলটি এলিয়ট ব্রিজের দিকে অগ্রসর হয়। বেলা ১১টার দিকে সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ। তাদের ছোড়া একটি গুলি লতিফের ডান পাশের পাঁজরে লাগে।
এরপর লতিফের নিথর দেহ পড়ে থাকে ব্রিজের ওপর। তার প্রতিবেশী হাসিনুর রশিদ ব্রিজের পূর্ব পাশ দিয়ে নামার সময় পেছন ফিরে তাকিয়ে তাকে পড়ে থাকতে দেখেন। আন্দোলনকারীদের কয়েকজন তাকে রিকশায় করে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
সে সময় লতিফের শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। হাসপাতালে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ৪ আগস্ট শহীদ হলেও তাকে ৬ আগস্ট সকালে জানাজা শেষে শহরের মালশাপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে সকালে এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত হয়।
১৯৭৮ সালের ১২ জানুয়ারি গয়লা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লতিফ। কিন্তু জন্মের আগেই হারিয়ে ফেলেন বাবা আসু মুন্সিকে। আর জন্মের তিন মাসের মাথায় মা বেদানাও না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। এরপর খালার কাছেই বড় হন আব্দুল লতিফ।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই খালাও মারা যান। এরপর চার খালাতো বোন লতিফের দায়িত্ব নেন এবং তারাই তাকে মানুষ করেন।
খালাতো বোনদের পারিবারিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় তারা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করেন। এই কারণেই আব্দুল লতিফ কখনো স্কুলের বারান্দা মাড়াতে পারেননি। একটু বড় হলে শুরু করেন নানা ধরনের কাজ। কখনো চায়ের দোকানে সহকারী হিসেবে, কখনো দিনমজুর হিসেবে।
লতিফের চার খালাতো বোন- সালেহা বেগম (৪৭), নাসিমা বেগম (৫০), শেফালী বেগম (৫৫) এবং জ্যোৎস্না (৬০)। তারা সবাই অন্যের বাড়িতে কাজ করেন।
লতিফের বোন সালেহা বেগম বলেন, ‘মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমরাই তাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছি। সেই ভাইটি আজ দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তাকে তো আর ফিরে পাবো না। ভাই বলে কাউকে ডাকতেও পারব না। ঘুমাতে গেলে মনে হয় আমার পাশে এসে ভাই ডাকছে। খেতে গেলে মনে হয় পাশে বসে খাচ্ছে। স্বৈরাচার কি পারবে আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিতে? বাবা-মা হারা ভাইটি দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিল।’
আরেক বোন শেফালী বেগম বলেন, ‘এতিম ভাইটাকে আমরা কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি, কোনো দিন বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দিইনি। আমাদের অভাবের সংসার ছিল, ওকে পড়াশোনা করাতে পারিনি। সে দিনমজুরের কাজ করত। কিন্তু দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। যারা তাকে হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘লতিফ বিভিন্ন সময় চায়ের দোকানেও কাজ করেছে। আমাদের নিজেদের থাকার জমি নেই। থাকি ভাড়া বাসায়। অভাবের সংসার হলেও ভাইকে নিয়ে চার বোন সুখেই ছিলাম। ভাই খুব সহজ-সরল মানুষ ছিল। কেউ কিছু বললে খুশিমনে করে দিত।’
সরকারের কাছে প্রত্যাশা প্রসঙ্গে বোন নাসিমা বেগম বলেন, ‘আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই। সে খুব ভালো ছেলে ছিল। তাকে কেন গুলি করে মারা হলো? আমি ভাইয়ের খুনিদের বিচার দেখে যেতে চাই। লতিফ আমাদের চার বোনের কাছে বড় হয়েছে। আমরা মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই। সরকার যদি একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে আমরা চার বোন একটু ভালোভাবে থাকতে পারতাম।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জ শহরের এলিয়ট ব্রিজের ওপর শহীদ হন দিনমজুর আব্দুল লতিফ। এ ঘটনায় সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ১৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে লতিফের খালাতো বোন সালেহা বেগম বাদী হয়ে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেছেন।
এই মামলায় সিরাজগঞ্জ-২ (সদর-কামারখন্দ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ড. জান্নাত আরা হেনরীকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
এসএইচ/এএইচ