নিজস্ব প্রতিবেদক
১৮ জুলাই ২০২৫, ০৪:০৩ পিএম
দুইটি পরিবার। দুইটি স্বপ্ন। দুইটি প্রাণবন্ত তরুণ। একজন ফুচকা বিক্রেতা, আরেকজনের পাইলট হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন চলাকালে এক মায়ের বুক খালি হয়ে গেছে যাত্রাবাড়ীর ফুটপাতে। আরেক মায়ের চোখের পানিতে ভিজে আছে বাগেরহাটের কয়রা উপজেলার বাঁশবাড়িয়ার মাটি।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রক্তেভেজা বাংলার মাটির দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে দুই তরুণের জীবন প্রদীপ একটি স্বৈরাচারী গুলির শব্দে মিলিয়ে গেছে একই নির্মম বাস্তবতায়। শহীদ বিল্লাল ও শহীদ আলিফ আহমেদ সিয়ামের গল্প তাই শুধু দুইটি মৃত্যুর নয়, এ গল্প দুইটি বিসর্জিত স্বপ্নের, একটি নিপীড়িত সময়ের।
‘ফুচকা বেঁচতাম না মা, আজ আন্দোলনে যামু’
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানার কলতাপাড়া গ্রামের এক টিনের ঘরে কান্নায় ভারী বাতাস। এই ঘরের প্রাণ ছিলেন বিল্লাল (২০)। মেজো ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তার কাঁধেই ছিল পুরো সংসারের ভরণপোষণের দায়িত্ব। সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল এলাকায় ছোট একটি ফুচকার দোকান চালিয়ে চলতো সংসার। বাবা হোসেন মিয়া অসুস্থ, বড় ভাই কর্মহীন। আর ছোট ভাই মানিক তখনও স্কুল ফেলে কাজে নামেনি। সব সামলাতেন বিল্লাল।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের সকাল। মা তাসলিমা বেগম রান্নাঘরে ডাল আর আলু ভর্তা করছেন, ছেলের প্রিয় খাবার। বিল্লাল বলল, ‘মা, আজ ফুচকা বেঁচতাম না, আন্দোলনে যামু।’ মা আঁতকে উঠে বললেন, ‘না বাপ, যাস না। চারিদিকে গণ্ডগোল, গুলি।’ কিন্তু ছেলের চোখে ছিল অদম্য স্পৃহা, গলায় ছিল প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা-‘সবাই দেশরে বাঁচাইতে নামছে মা, আমিও যামু।’
সেদিন যাত্রাবাড়ীর রাজপথে পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন বিল্লাল। গুলি লাগে মাথায়। সেই রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। বড় ভাই মামুন বলেন, ‘হাঁইটা ঢাকা মেডিকেলে গেছি, দেখি ভাইটা রক্তে ভাসতেছে। চিকিৎসা ঠিকমতো হয় নাই। যা যা আনতে বলছে, আনছি। রক্ত, ওষুধ-সব। কিন্তু কিছুই আর কাজ করে নাই।’
বিল্লালের মৃত্যুর পর পরিবার পেয়েছে শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু সন্তানের মূল্য যে কোটি টাকা দিয়েও পূরণ হওয়ার নয়। ছেলের কথা মনে করে আজও ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা।
‘হয় বীরের মতো বাঁচব, নয় বীরের মতো মরব’
বাগেরহাটের কয়রা উপজেলার বাঁশবাড়িয়ার কিশোর আলিফ আহমেদ সিয়াম (১৫) ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতেন পাইলট হবেন। আকাশ ছুঁবেন। বিশ্ব দেখবেন। মা-বাবাকে নিয়ে হজে যাবেন। মা তানিয়া আক্তার ছিলেন শিক্ষক, যিনি ছেলেকে ডাক্তার বানাতে চাইতেন। কিন্তু ছেলের ইচ্ছা ছিলো আকাশে ওড়ার।
সাভারের ডেইরি ফার্ম হাই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র সিয়াম নিয়মিত অংশ নিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। কোটা সংস্কারের দাবিতে, শিক্ষাবাণিজ্য বন্ধে সিয়াম ছিলেন রাজপথের সাহসী কণ্ঠ। ছোটবেলায় বারবার ভর্তি পরীক্ষা পাস করেও কোটা-নীতির কারণে ঠাঁই পায়নি জাহাঙ্গীরনগর স্কুলে। তাই আন্দোলন তার কাছে ছিল ব্যক্তিগত লড়াইও।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুরে সাভার বাসস্ট্যান্ডে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেয় সিয়াম। ফুটওভার ব্রিজের নিচে গুলি লাগে তার মাথায়। ভ্রুর মাঝখান দিয়ে ঢুকে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে এনাম মেডিকেলে নেওয়া হয়। কিন্তু রক্ষা করা যায়নি। ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকাকালীন শহীদ হন তিনি।
সিয়ামের মা তানিয়া আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমি স্বামীর নাম নাহ, আমার ছেলের নামে পরিচিত হতে চেয়েছিলাম। এখন সবাই আমায় শহীদ আলিফের মা বলে ডাকে।’
তার বাবা বুলবুল কবীর, একজন ব্যবসায়ী। বলেন, ‘সিয়াম ফ্যাসিস্ট শাসন পতনের আন্দোলনে জীবন দিয়েছে। আমি চাই তার নামে একটি স্কুল, কলেজ, অথবা হাসপাতালের নামকরণ হোক।’
জুলাই মাসে শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন সিয়ামের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ এবং স্থানীয় বিএনপি ১ লাখ টাকা দিয়েছে। তবে তারা বলছেন, টাকা লাগবে না, হত্যার বিচার চাই।
এমআই/ইএ