নিজস্ব প্রতিবেদক
১৫ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪৫ এএম
রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী সোহাগকে পিটিয়ে ও পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে পরিচিত মাহমুদুল হাসান মহিন, ঘটনার পর রাস্তায় সোহাগের লাশ রেখে নিজের লোকজন নিয়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। ওই সময় সামাজিকমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায় মহিন নিজেই হত্যার মূল অভিযুক্ত, অথচ সোহাগের লাশের পাশেই দাঁড়িয়ে ‘চাঁদাবাজের ঠাঁই নাই’ বলে চিৎকার করছেন।
স্থানীয় সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে— মাহমুদুল হাসান মহিন বহুদিন ধরেই মিটফোর্ড এলাকায় চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। অস্ত্রবাজি, হামলা, মারামারি, দখল ও বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে তার নাম রয়েছে। এলাকায় এক ভয়ঙ্কর চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মহিন।
গত বুধবার সন্ধ্যায় মিটফোর্ড এলাকায় প্রকাশ্যে সোহাগকে পিটিয়ে ও মাথায় পাথর মেরে হত্যা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, লাশের ওপর লাফিয়ে হত্যাকারীরা উল্লাসে মেতে ওঠে। এত ভয়াবহ দৃশ্য দেখে উপস্থিত শত শত মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রতিবাদ করতে সাহস করেননি কেউ।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই মহিন তার অনুসারীদের নিয়ে সড়কে নাটকীয়ভাবে ‘চাঁদাবাজবিরোধী’ মিছিল করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি উচ্চ স্বরে বলছেন, ‘চাঁদাবাজের ঠাঁই নাই!’ ও ‘আওয়ামী দোসরদের বিচার চাই!’। পুলিশও এই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। পরে ভিডিও ফুটেজ দেখে কোতোয়ালি থানা পুলিশ মহিনকে শনাক্ত করে।
তবে মহিনকে আটক করতে গিয়ে পুলিশকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। স্থানীয়ভাবে কিছু লোক পুলিশকে হুমকি দেয় এবং বলপ্রয়োগেরও চেষ্টা করে। পুলিশের এক কর্মকর্তা সাহসিকতার সঙ্গে মহিনকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করেন এবং থানায় নিয়ে যান। পরে তার দেওয়া তথ্যমতে আরেক অভিযুক্ত তারেক রহমান রবিনকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এটি কোনো তাৎক্ষণিক উত্তেজনার ফল নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। মহিন ও তার দল সোহাগকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তারা চেয়েছিল যেন ঘটনাটি উত্তেজিত জনতার প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত ‘মবকাণ্ড’ হিসেবে মনে হয়। হত্যার পরপরই নিজেদের বানানো নাটকে ‘জনরোষ’ দেখিয়ে স্লোগান দেওয়ার মাধ্যমে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল তারা।
তবে হত্যার ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এটি ছিল একটি পরিকল্পিত, ঠাণ্ডা মাথার, চরম সহিংসতায় ভরা হত্যাকাণ্ড, যার উদ্দেশ্য ছিল এলাকায় নিজেদের ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রকাশ।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ঘটনাটির পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচও। এই ঘটনায় চাঁদাবাজি বা দোকান দখল বড় কোনো বিষয় নয়, বরং দলীয় পরিচয়ের আড়ালে ক্ষমতার দাপট দেখানো ও প্রতিপক্ষকে নির্মূল করাই ছিল মূল লক্ষ্য। তদন্তে উঠে আসছে ছাত্রদল ও যুবদল সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত। তবে বিষয়টি আরও তদন্তাধীন।
কোতোয়ালি থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ঘটনার পর মহিন ও অন্যরা নিজেরাই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মিছিল-স্লোগান দিয়েছিল। আমরা আগে থেকেই তাকে শনাক্ত করি এবং পরে আটক করি। মিছিলটি অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের ছিল না।
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে আরও কয়েকজনকে। রাজীব বেপারী ও সজীব বেপারী নামে দুই সহোদরকে পাঁচদিনের রিমান্ডে দিয়েছেন আদালত। তারেক রহমান রবিনকে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে সোহাগ হত্যা মামলাতেও তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
মাহমুদুল হাসান মহিনকে ১০ জুলাই পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। টিটন গাজীকেও ১২ জুলাই পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। আলমগীর ও মনির ওরফে লম্বা মনিরকেও চার দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।
সোহাগ হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংস ঘটনায় আসামিদের পক্ষে আইনি সহায়তা না দিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম (ঢাকা বার ইউনিট)। সোমবার (১৪ জুলাই) এক সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের আহ্বায়ক মো. খোরশেদ আলম জানান, এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেউ আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন না।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ফোরামের সদস্য সচিব নিহার হোসেন ফারুক, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পাবলিক প্রসিকিউটর ইকবাল হোসেন, আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল খালেক মিলনসহ আরও অনেকে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সোহাগ হত্যার এই ঘৃণ্য নৃশংসতার তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা জানাচ্ছি। অনতিবিলম্বে সকল আসামির দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
এইউ