নিজস্ব প্রতিবেদক
১৪ জুলাই ২০২৫, ০২:২৪ পিএম
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার রাজপথে চলছিল স্বৈরশাসন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিজয়ের মিছিল। উত্তপ্ত দুপুরে জনতার ঢল নেমেছিল রাস্তায়। সেই উত্তাল দিনে যখন হাসিনার পতন ঘটে, তখনই নিঃশেষ হয়ে যায় নাহিদ ও সুলাইমান নামের দুই কিশোরের জীবন। তারা কেউই রাজনীতির কর্মী ছিল না, ছিল না কোনো দলের ছায়ায়। কিন্তু ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ফরজ’—এই বিশ্বাসই তাদের রাজপথে টেনে এনেছিল।
হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মুড়িয়াউক গ্রামের মাদরাসাছাত্র নাহিদ মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারায়। বড় ভাই মুফতি নাইমুল ইসলাম তাকে ঢাকার মাদরাসায়ে মাদীনাতুল উলুমে ভর্তি করান। পরে সে খুলনার একটি মাদরাসায় চলে যায়। ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল, নাহিদ বড় আলেম হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে পড়বে। জমি বিক্রির প্রস্তুতিও চলছিল। তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় মাদরাসায় অনুপস্থিতির অভিযোগ ওঠে। ফলে ভাই তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। মোহাম্মদপুরে চাচার বাসায় ওঠার পর ৫ আগস্ট দুপুরে সে বিজয় মিছিলে অংশ নেয়।
আদাবর থানার সামনে পুলিশের ছোড়া গুলি তার বুকে লাগে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গুলিবিদ্ধ হয়ে সে পাশেই বসে পড়ে। কিছুক্ষণ পর থানার সামনে থাকা পরিত্যক্ত গাড়িতে আগুন ধরানো হলে তার নিথর দেহ সেই আগুনে দগ্ধ হয়। শরীরের বাম দিক, মুখ থেকে পা পর্যন্ত পুড়ে যায়। বিকেল ৫টার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন মর্গে বড় ভাই লাশ শনাক্ত করেন। লাশ গোসল করানোর সময় তার পিঠ থেকে একটি গুলি বের করা হয়। দাফন করা হয় মা-বাবার কবরের পাশে।
অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জের মাদানীনগরের কিশোর সুলাইমান ছিলেন এক প্রবাসী পরিবারের সন্তান। বাবা ছিলেন সৌদি প্রবাসী, মা রোকসানা বেগম তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন আলেম হওয়ার। সে পড়ত মিরপুরের দারুর রাশাদ মাদরাসায়। ৫ আগস্ট সকালে খিচুড়ি-ডিমভাজি খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। মা তাকে বারবার নিষেধ করলেও সে বলেছিল, যে পুরুষ, সে কি অত্যাচার দেখে ঘরে থাকে? কয়েকদিন আগে সিদ্ধিরগঞ্জে ডাচ-বাংলা ব্যাংকে আগুন লাগার সময় আহতদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সে নিজ হাতে। সেদিন সে মাকে বলেছিল, আম্মি, আমি গুলিবিদ্ধ ছেলে হাসপাতালে দিছি। তখন মা বলেছিলেন, তুই গুলিতে মরলে কে নিবে তোকে হাসপাতালে?
সেই ভয়ই বাস্তবে রূপ নেয়। যাত্রাবাড়ীর কাজলায় পুলিশের গুলিতে আহত হয় সুলাইমান। যোহরের আযানের পর ফোন রিসিভ করেও কিছু বলতে পারেনি সে। মা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেছিলেন, সুলাইমান, তুই কোথায়? ওপাশে ছিল নিঃস্তব্ধতা। রাতেই ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পাওয়া যায় তার মরদেহ। জানাজা শেষে দাফন করা হয় মাদানীনগর কবরস্থানে।
নাহিদ ও সুলাইমানের নাম এখন সরকারি গেজেটের শহীদ তালিকায় রয়েছে। একজন ৩৭২ নম্বরে, অন্যজন ৪৮৯ নম্বরে। কিন্তু সংখ্যার আড়ালে লুকিয়ে আছে একেকটি ভেঙে যাওয়া পরিবারের কান্না, স্বপ্নভঙ্গের আর্তি। নিহতদের পরিবার বলছে, বিজয়ের উল্লাসের দিনও তাদের হৃদয়ে ছিল অপূরণীয় ক্ষতির বেদনা। এখন তারা শুধু বিচার চান—যাতে আর কোনো কিশোরের স্বপ্ন না নিভে যায় রাজপথের ধোঁয়ায়।
এমআই/এইউ