মাহাবুল ইসলাম
১২ জুলাই ২০২৫, ০৪:১৯ পিএম
ঢাকার রাজপথ কখনোই স্থির থাকে না—এটা শুধু শোরগোল আর জ্যামের ক্ষেত্র নয়; এটি এক বিশাল স্মৃতির ভাণ্ডার। এখানে প্রতিটি ধুলিকণা, প্রতিটি সড়কপথের বাঁক যেন এক একটি ইতিহাসের সাক্ষী। এই পথ যেন কাঁদে, হাহাকার করে, আবার গর্বিত হয়ে ওঠে। ঢাকার রাজপথ একটি চলমান পাঠশালাও, যেখানে ইতিহাস জীবিত থাকে।
সে পাঠশালায় এবার রং তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে জুলাই বিপ্লবের রক্তমাখা ইতিহাস ও স্মৃতি। রাজপথে চলতে চলতে যখন চোখে পড়বে পুরোনো স্লোগান, যখন বুকের ভেতর গুমরে উঠবে কোনো হারানো মানুষের নাম, তখন মনে হবে যেন তুমি চলমান ইতিহাসের অংশ।
বিপ্লবের জুলাই পেরিয়ে বিজয়ের জুলাই ফিরে আসতেই রাজপথের ব্যস্ত শরীরে পুরোনো স্মৃতিচিহ্ন আঁকা হচ্ছে। রাজপথে ফিরে তাকাতেই চোখে ভেসে উঠছে ছাত্রদের স্লোগান, মায়ের আহাজারি, পুলিশের ব্যারিকেড, আর রক্তমাখা রাস্তাগুলোর গল্প।

রাজপথে ফিরে আসা জুলাইয়ের স্মৃতির কাহিনী
ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি সড়কপথ যেন জীবন্ত এক গ্রাফিতির প্রদর্শনী। মেট্রোরেলের পিলারগুলো আজ শুধু কাঠামো নয়, তারা যেন এক ধরনের বিশাল ক্যানভাস, যেখানে ইতিহাসের রং-বাহারের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠছে এক ভয়াবহ সময়ের ছবি। মেট্রোরেলের প্রতিটি স্তম্ভে প্রকাশ পাচ্ছে কখনো শোক আবার কখনো প্রতিরোধের গল্প। যেন ২০২৪ সালের জুলাইয়ের সেইসব দিনের মুহূর্তগুলো ঘুরে ফিরে এসেছে, জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ছাত্রদের চোখে বিস্ফোরিত ক্রোধ, অধিকার আদায়ে তুমুল আন্দোলন, রাস্তা অবরোধ, ছেঁড়া ব্যাগ, রক্তমাখা পোশাক, পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলিবৃদ্ধ শরীরসহ ক্যাম্পাসের গর্জন যেন আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পথচারী ও যাত্রীদের কানে।
যুদ্ধ, প্রতিবাদ, ও স্মৃতির মিছিল
জুলাইয়ের রাজপথ দেশের প্রেক্ষাপটে অদ্ভুত এক সংহতির ছবি আঁকে। ডান-বাম- সব মত ও সব ঘরানার মানুষ এই মাসে এসে দাঁড়ায় একই ফ্রেমে। কেউ আসে মোমবাতি হাতে, কেউ ব্যানারে মুখ ঢেকে, কেউ আসে নীরবে। কেবল হেঁটে যায় সেই পথ ধরে যেদিন তার কোনো কাছের মানুষ আর ফেরেনি। যাত্রাবাড়ী থেকে পল্টন, মিরপুর ও উত্তরা—অবিরত এই পথযাত্রা, শুধুমাত্র এক দিন নয়, এটি এক অসীম স্মৃতির বহনকারী।

পল্টন থেকে মিরপুরের দিকে যাচ্ছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী আবু সালেহ। তিনি বলেন, যে সময় আন্দোলন তুঙ্গে, সে সময় আমি ঢাকাতেই। চোখের সামনে লাশ পড়তে দেখেছি। দেখেছি প্রতিবাদের হাজারো ভাষা। সে সময় গ্রাফিতিগুলোও আমাদেরকে উজ্জীবিত রেখেছে। এই সড়কে যখন সেই পুরোনো স্মৃতি দেখি, তখন স্বাভাবিকভাবেই আবেগ আপ্লূত হয়ে যাই।
সম্প্রতি ঢাকায় চাকরির প্রস্তুতির জন্য এসেছেন শামসুন্নাহার। তিনি বলেন, এই আন্দোলনে প্রথম থেকে সরাসরি সম্পৃক্ত না হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। তবে মফস্বলের চিত্রগুলো খুব কমই ক্যামেরাবন্দি হয়েছে। যে চিত্রগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে উজ্জীবিত হয়েছি, সেগুলো মেট্রোরেলের দেয়ালে আঁকা দেখে পুরনো স্মৃতি আওড়াচ্ছি। এই স্মৃতি একদিকে যেমন ভালোলাগার, তেমনি কষ্টেরও।
‘ফিরে দেখা ফ্যাসিস্ট রেজিম’
ব্যতিক্রমী এই আয়োজনের পেছনে রয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
‘ফিরে দেখা ফ্যাসিস্ট রেজিম’ শিরোনামে এই গ্রাফিতি অঙ্কন কার্যক্রমটি স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়নে পরিচালিত হচ্ছে।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছেন, এই উদ্যোগ মূলত এক ভয়াল শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণমানুষের ত্যাগ আর প্রতিবাদের গৌরবময় স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস। এক সময় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো জনগণের সংগ্রাম, শহীদের আত্মত্যাগ এবং গণ-অভ্যুত্থানের অবিস্মরণীয় অধ্যায় চিত্রিত হচ্ছে এই গ্রাফিতির মাধ্যমে।
এই প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন তরুণ শিল্পীরা, যারা তুলির মাধ্যমে তুলে ধরছেন নির্যাতনের চিত্র, নিখোঁজের কান্না, লাঠিচার্জের ভয় এবং গণআন্দোলনের গৌরব। প্রতিটি পিলার যেন একেকটি জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে আঁকা হচ্ছে নিপীড়নের দিনলিপি ও গণতন্ত্রের প্রতীক্ষা।
এমআই/ইএ