জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
০৯ জুলাই ২০২৫, ০৬:৫৯ পিএম
মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার হওয়াসহ আলোচিত কিছু দুর্নীতি-অনিয়মের তদন্ত করতে গিয়ে সামনে আসেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন। দেশজুড়ে তোলপাড় হওয়া সেসব তদন্তের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে ‘হত্যা’ ও ‘চাকরি খাওয়ার’ হুমকির অভিযোগও ওঠে।
কিন্তু ২০২২ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের আমলে উল্টো এই তরুণ কর্মকর্তাকেই ‘অব্যাহতভাবে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করায়’ কমিশনের ‘ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে’ নোটিস ছাড়াই চাকরিচ্যুত করে দুদক।
চাকরি হারানোর তিন বছরেরও বেশি সময় পর অবশেষে হাইকোর্ট আলোচিত সেই শরীফের চাকরি ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। একইসঙ্গে রায় পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে পাওনা বেতন-ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করতে বলা হয়েছে।
যেভাবে আলোচনায় আসেন শরীফ উদ্দিন
চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় শরীফ উদ্দিন রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা সনদ দেওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচনায় আসেন। ২০২১ সালের জুন মাসে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে তিনি বাদী হয়ে মামলাও করেন।

এছাড়া অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ স্থানান্তর ও নতুন সংযোগ প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) বিভিন্ন অভিযোগ নিয়েও তদন্ত করেন শরীফ। পরে অভিযোগের ‘সত্যতা পেয়ে’ কেজিডিসিএলের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ সাবেক বৈদেশিক ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলে মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজনকে আসামি করে ওই বছর তিনি মামলা করেন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ নিয়েও তদন্ত শুরু করেছিলেন।
এর বাইরেও কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা দুর্নীতির ঘটনায় ১৫৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন শরীফ। যেখানে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারাও ছিলেন। এসব বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে রোষানলে পড়ার অভিযোগ করেছিলেন দুদকের এই কর্মকর্তা। ওই সময় তাকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি।
শরীফকে অপসারণের আদেশ প্রত্যাহারে সহকর্মীদের মানববন্ধন
আলোচিত এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তৎকালীন সময়ে চাকরিবিধি লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগ করা হয়। একসময়ে দুদক বিনা নোটিসে তাকে তিন মাসের বেতন-ভাতার সুবিধা দিয়ে চাকরি থেকে অপসারণ করে।
২০০৮ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালার ৫৪ (২) বিধি অনুযায়ী, কোনো কারণ না দর্শিয়ে কোনো কর্মচারীকে ৯০ দিনের নোটিস দিয়ে অথবা ৯০ দিনের বেতন পরিশোধ করে চাকরি থেকে অপসারণ করার সুযোগ আছে।
সেখানে বলা হয়, প্রজ্ঞাপন জারির দিন থেকে তার অপসারণের আদেশ কার্যকর হবে এবং বিধি অনুযায়ী তিনি ৯০ দিনের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

অন্যদিকে শরীফকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়টি নিয়ে ওই সময় তার সহকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। ঢাকার সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন তারা। যা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
দুদকের এই কর্মকর্তা অপসারণ নিয়ে সরকারি সংস্থাটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. মঈনুদ্দিন আবদুল্লাহর ভাষ্য ছিল, শরীফ উদ্দিন এমন কিছু করেছিলেন, যাতে ওই সিদ্ধান্ত নিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সে যে কাজ-কারবার করেছে, তাতে তাকে নোটিস দিয়ে অপসারণ করার প্রয়োজন নেই। সে এমন অনিয়ম করেছে, তাকে সরাসরিই অপসারণ করতে হয়েছে।’
অবশ্য অপসারণ নিয়ে শরীফের বক্তব্য ছিল, প্রভাবশালীদের রোষানলের শিকার হওয়ায় তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে।
চাকরি ফেরত পেতে উচ্চ আদালতে যান শরীফ
চাকরি হারানোর পর একটা সময় শরীফ দোকানেও চাকরি করেন। এর আগে চাকরি ফেরত চেয়ে ২০২২ সালেল ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে আবেদন করেন শরীফ। দুর্নীতি দমন কমিশন চাকরি বিধিমালা-২০০৮ এর ৪৮ বিধি অনুযায়ী অপসারণের আদেশ পুনঃনিরীক্ষা করে অপসারণের আদেশ প্রত্যাহার করার আর্জি জানানো হয় সেখানে। কিন্তু দুদক সেই আবেদন নাকচ করে দেয়।

পরে ওই বছরের ১৩ মার্চ চাকরি ফেরত চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মো. শরীফ উদ্দিন।
বুধবার (৯ জুলাই) সেই রিট আবেদনের ওপর শরীফের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন দোলন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। স্থায়ী চাকরিজীবী হওয়ার পরও তিন মাসের বেতন দিয়ে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। তার চাকরিচ্যুতির আদেশের বিরুদ্ধে আমরা যে রিট করেছি, তাতে যে রুল জারি করেছিল, সেই রুলে আজ চূড়ান্ত শুনানি হয়েছে এবং শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করা হয়েছে।’
সালাউদ্দিন দোলন জানান, এ রায় পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তার জ্যেষ্ঠতাসহ সকল বেনিফিটসহ চাকরিতে পুনর্বহাল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘তাকে (শরীফ) দুদক চাকরি বিধিমালার ৫৪ এর ২ ধারায় যে বরখাস্ত আদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ, ধরে নেওয়া হবে যে, তিনি সবসময় চাকরিতে বহাল ছিলেন।’
বিইউ/এএইচ