মাহাবুল ইসলাম
০৮ জুলাই ২০২৫, ০৯:২৬ পিএম
দেশে জরায়ু-মুখ ক্যানসারে প্রতি বছর নতুন করে আক্রান্ত হন আট হাজার ২৬৮ জন, মৃত্যু ঘটে চার হাজার ৯৭১ জনের। স্তন ক্যানসারের চিত্র আরও ভয়াবহ। প্রতি বছর ১৩ হাজার ২৮ জন আক্রান্ত, মৃত্যু ছয় হাজার ৭৮৩ জনের। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে এই মৃত্যুহার কমাতে সরকার ১৮৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে শুরু করে ‘ইলেকট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যানসার নির্ণয় কর্মসূচি’। লক্ষ্য ছিল প্রান্তিক নারীর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে বিনামূল্যের স্ক্রিনিং সেবা। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে গিয়ে এই প্রকল্প দুর্নীতির ভারে নুয়ে পড়েছে। প্রাণ বাঁচানোর প্রকল্পেই যেন প্রাণ খুঁজে পাওয়া ভার!
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কোথাও সেবা নেই, কোথাও যন্ত্র পড়ে আছে অব্যবহৃত, কোথাও আবার কর্মীদের সম্মানী আত্মসাৎ করে তাদেরই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে মুখ বন্ধ করতে। কাগুজে সংখ্যার পাহাড় বাড়লেও প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই মাঠ পর্যায়ের বাস্তবায়নে অধরা। দুর্নীতি, অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার ছায়ায় শুধু প্রকল্প নয়, সরকারের স্বাস্থ্যসেবার ভাবমূর্তিও চরম প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ওপর। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন বিএসএমএমইউ গাইনিকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা। যার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও অর্থ লোপাটের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে।
অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ
২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রকল্পের আওতায় যেসব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যবহার করা হয়নি। চাহিদা না থাকার পরও কেনা হয়েছে যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্র পড়ে রয়েছে অব্যবহৃত অবস্থায়, যেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও করা হয়নি।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, শুধু অব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ায় ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৩৮ লাখ ৩৯ হাজার টাকা।
গবেষণা কিংবা প্রয়োগে ব্যবহারযোগ্য এমন উপাদান বা রিএজেন্ট কেনা হয়েছে বিপুল পরিমাণে। যেগুলোর চাহিদা প্রকল্পের কোথাও ছিল না। এই চাহিদাবিহীন রিএজেন্ট কেনায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৯৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
প্রকল্পে ব্যবহৃত রেজিস্ট্রেশন ও রেফারাল স্লিপের মাপ নির্ধারিত স্পেসিফিকেশনের চেয়ে কম হওয়ায় কার্যকারিতা কমে গেছে। ফলে প্রকল্পের মূল কার্যক্রমেই দেখা দিয়েছে ঘাটতি। এতে করে সরকার ১২ লাখ ৯৪ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। এই অনিয়ম শুধু আর্থিক ক্ষতির নয়; বরং তথ্য সংরক্ষণ ও রোগী ব্যবস্থাপনায় এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে।
প্রকল্পে ব্যবহৃত সামগ্রী সরবরাহকারীদের বিল থেকে যথাযথ হারে আয়কর কর্তন করা হয়নি। এই অনিয়মের কারণে সরকার ছয় লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৬ টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। কর বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মদদে।
অডিট রিপোর্ট বলছে, বাজারদরের তুলনায় অতিরিক্ত দামে স্পঞ্জ হোল্ডার কেনা হয়েছে, যার ফলে ২৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। এ ধরনের অতিমূল্যে কেনাকাটা কোনো ব্যতিক্রম নয়, বরং একটি রুটিন লুটপাটের অংশ বলেই মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
উৎসব ভাতা থেকে অডিট আপত্তি ধামাচাপা
২০২১-২২ অর্থবছরেও প্রকল্পে একই ধরনের আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীদের ২২ লাখ ৬১ হাজার টাকা উৎসব ভাতা প্রদান করা হয় অর্থ বিভাগের পরিপত্র লঙ্ঘন করে। একই সময়ে অ্যাসিটিক এসিড, প্রশিক্ষণ ব্যাগ ও মুদ্রণ সামগ্রী অতিরিক্ত দামে কিনে ৫৯ লাখ ৮১ হাজার টাকার বেশি লুট করা হয়। এছাড়াও ৮১ হাজার টাকা আয়কর কম কর্তন এবং ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার অডিট আপত্তি কৌশলে নিষ্পত্তি করার অভিযোগ রয়েছে।
সবচেয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ এসেছে প্রকল্পে নিয়োজিত ৬৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষ থেকে। জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রকল্পের এই অভিযোগ করেন তারা।
তারা জানান, প্রশিক্ষণ, ক্যাম্প ও কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দকৃত সম্মানীর অর্থ প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা আত্মসাৎ করেছেন। হিসাব মতে, এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত কোটি টাকারও বেশি।
ডা. সাদিয়া মাহবুব রিপা বলেন, প্রকল্প পরিচালক শুরুতে জানান কোনো সম্মানী বরাদ্দ নেই। অথচ পরে আমরা জানতে পারি, প্রতিটি প্রশিক্ষণ, ক্যাম্প ও স্বাস্থ্য কার্যক্রমে আমাদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সম্মানী। এই টাকা চেয়ে লিখিতভাবে আবেদন করা হলে প্রকল্প পরিচালক টাকা দিতে অস্বীকার করেন এবং জানান, অডিট সামলানো, মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ‘ডেস্ক ম্যানেজ’ ও গাড়ি ভাড়ার খাতে এই টাকা ব্যবহার করা হয়েছে।
এদিকে, টাকা চাওয়ার পরপরই ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে প্রকল্পে নিয়োজিত সব কর্মীকে একসঙ্গে চাকরিচ্যুত করা হয়। অভিযোগকারীদের মতে, এটি ছিল তাদের মুখ বন্ধ করতে ‘প্রশাসনিক শাস্তি’। এরপর থেকেই প্রকল্প পরিচালক ও গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিরিন আক্তার বেগমের পক্ষ থেকে হুমকি আসতে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। কর্মীরা বিএসএমএমইউ উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে তদন্ত কমিটির দাবি জানালে তিনি তা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। কিন্তু সিন্ডিকেট সভা শেষে সেই আশ্বাস কার্যকর হয়নি বলে জানা গেছে।
নেই ফলোআপ ও রেকর্ড
প্রকল্পটির অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হলো রোগীর ফলোআপ নিশ্চিত করা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফলোআপ দূরের কথা রেকর্ডই নেই। জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসারের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার। প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৪৯২টি উপজেলায় এই সেবা পরিচালনার কথা। কিন্তু এই জেলার আট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোথাও এই প্রকল্পের কার্যক্রম নেই।

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘উপজেলায় এই প্রকল্পের কোনো কাজ নেই। যতদূর জানি, জেলা হাসপাতালে এই প্রকল্পের কাজ আছে।’
এদিকে, সরকারি সংস্থা আইএমইডির সরেজমিন পরিদর্শনেও অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, প্রকল্পের অধীনে রেজিস্টারের তথ্য অসম্পূর্ণ, সব কলাম পূরণ করা হয় না। রেফারেল রোগীদের তথ্য উপাত্ত রেকর্ড করা হয় না, ফলে সেবা নিশ্চিতের নজরদারি নেই। মাসিক টার্গেটও পূরণ হচ্ছে না। অথচ কেন্দ্রীয় প্রতিবেদনে তা গোপন করা হয়েছে। কক্সবাজার জেনারেল হাসপাতাল, রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ অনেক জায়গায় স্ক্রিনিং কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ। কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন, কল্পোস্কোপি মেশিন নেই, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল নেই, ফলোআপ ব্যবস্থাও স্থবির।
সরেজমিনে বিএসএমএমইউর স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
গত ১৮ জুন সরেজমিনে বিএসএমএমইউর স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, স্ক্রিনিং কার্যক্রমের তেমন গুরুত্ব নেই। প্রশিক্ষণ নিয়েই ব্যস্ত কর্মকর্তারা। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১২টা মাত্র তিন ঘণ্টা স্ক্রিনিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সেখানেও রোগীরা দুর্ভোগের মুখে পড়ছেন। সেখানকার সেবাদানকারীদের আচরণেও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সেবাপ্রার্থীরা।
সামিনা ইয়াসমিন নামের এক সেবাপ্রার্থী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল দুপুর ২টার মধ্যে গেলেই স্ক্রিনিং টেস্ট করা যাবে। আমি সাড়ে ১২ টায় এসেছি। এখানকার দায়িত্ব নিয়োজিতদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কেউ কথা বলতে চায় না। একজন নার্স সে তো রীতিমতো দুর্ব্যবহার শুরু করল। সবশেষ সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে রোগীকে ডেকে নিয়ে টেস্ট করান এখনকার দায়িত্বরত কর্মীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘাটতিগুলোর কারণে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য নারীর প্রাথমিক ক্যানসার শনাক্তকরণ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
আরও পড়ুন
এমপি-মন্ত্রী-আমলাদের দুর্নীতির বিশ্বস্ত পাহারাদার স্ত্রী ও প্রেমিকারা!
সমাজসেবার প্রকল্পে লুটপাট, ১০ হাজার টাকা পায়নি প্রশিক্ষণার্থীরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রকল্প ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রকল্পকে কিছু ব্যক্তি নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। এই অবস্থার উত্তরণে প্রকল্পের মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা না হলে সাধারণ মানুষ প্রকৃত অর্থে উপকারভোগী হবেন না। প্রকল্প বাস্তবায়নে জবাবদিহিতা আরও শক্তিশালী করতে হবে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত না হলে কার্যত এসব দুর্নীতি থামবে না।’
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বিএসএমএমইউ গাইনিকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসার নেসার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করা হলে তিনি ব্যস্ততার অজুহাতে কথা বলেননি। পরে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি না।’
এমআই/জেবি