images

জাতীয়

শহীদের সাদা পাঞ্জাবি আর স্বপ্নভরা চোখ: নূর ও সোহাগের শেষযাত্রা

নিজস্ব প্রতিবেদক

০৮ জুলাই ২০২৫, ০৫:৪০ পিএম

সাদা পাঞ্জাবি, টুপি আর স্বপ্নভরা চোখ নিয়ে দুই কিশোর রওনা হয়েছিল একটি আলোর পথে। যে পথে গন্তব্য ছিল সমানাধিকার, স্বাধীনতা আর এক বৈষম্যহীন দেশ। কিন্তু সে পথ রক্তাক্ত হল, নিভে গেল তাদের আলোর চোখ। বলছি শহীদ সামিউ আমান নূর এবং মো. সোহাগের কথা।

তাদের দুজনের জীবনই ছিল সংগ্রামমুখর, কিন্তু স্বপ্নের দ্যুতি ছিল চোখে-মুখে। একা একা দাঁত চেপে লড়াই করা পরিবার, প্রান্তিক মানুষের জীবনের দহন, আর অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র দুটি বুকের জেগে ওঠা প্রতিবাদ— সবই যেন মিশে গেছে একই পরিণতিতে।

নূর: ‘তোমাদের সবাই আমার নামেই চিনবে’

মাত্র ১৩ বছর বয়সেই পরিবারকে বলেছিল, “আমি বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবো। মানুষ তোমাদের আমার নামেই চিনবে।’ গাজীপুরের টঙ্গীর পূর্ব আরিচপুর গাজীবাড়ির এই কিশোর তখনও জানত না, ইতিহাসে তার নাম লেখা হবে শহীদের তালিকায়।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের খবরে উত্তেজিত নূর দৌঁড়ে বেরিয়ে পড়ে বিজয়ের মিছিলে। উত্তরা ফ্লাইওভারের ওপর সন্ত্রাসীদের গুলিতে সে পড়ে যায়। নিথর দেহ আর ফিরল না।

এক বন্ধু জানায়, এর আগেও ১৯ জুলাইয়ের ঘটনায় তার পায়ে লেগেছিল রাবার বুলেট। পরিবার কিছুই জানত না। হয়তো জানলে তাকে ঘর থেকে বের হতে দিত না।

সাদা পাঞ্জাবি আর পবিত্র উচ্ছ্বাসে সে জুমার দিনে যোগ দিয়েছিল আন্দোলনে। বিশ্বাস করতো, সত্যের জয় হবেই। মাথায় গুলির আঘাতে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে নেওয়া হয় উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে। কোরআন পাঠ করা, রোজা রাখা, মানুষকে ভালোবাসা ছেলেটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চিকিৎসার আগেই।

নূরের মা শাহানুর আমান কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলে তো আল্লাহর রাস্তায় চলতো। আমি শুধু চাই, আল্লাহ যেন ওকে কবুল করে নেয় শহীদ হিসেবে।’

সোহাগ: সেলাই করা বালিশের স্বপ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া এক কিশোর

রংপুরের পীরগঞ্জের বড় পাহাড়পুর গ্রামের ১৭ বছরের সোহাগ। আট পারা কোরআন মুখস্থ করেও দরিদ্রতার কাছে হার মানতে হয়েছিল। মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় ছোটখাটো চাকরি নেয়। একটি প্রিন্টিং প্রেসে মাসিক ৭৫০০ টাকায় কাজ করতো। 

১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার। মা সালমা বেগম সেদিন রান্না করেছিলেন ছেলের প্রিয় ভর্তা আর ডাল-ভাত। সকালে সেলাই করছিলেন সাদা রঙের একটি বালিশের কভার, ছেলের পছন্দের রঙ বলে। 

সোহাগ বলেছিল, সেই বালিশেই সে ঘুমাবে। কিন্তু সে ঘুম হয়েছিল স্থায়ী। পবিত্র জুমার নামাজ শেষে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা ও টুপি পরে সে যোগ দেয় ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী মিছিলে। কাছ থেকে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়।

বাবা রেজাউল মিয়া হাসপাতালে গিয়ে লাশ শনাক্ত করতে গিয়ে জ্ঞান হারান। মৃতদেহ নিতে রাস্তায় বাধা দেয় আওয়ামী লীগপন্থীরা। লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। চালকরা চাঁদা তুলে ৩০ হাজার টাকায় ভাড়া করা হয় একটি অ্যাম্বুলেন্স। তারপরও বাধা পেয়ে পিকআপে করেই গভীর রাতে রওনা দেন। সকালে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে ছেলের দাফন করেন দাদার কবরের পাশে।

ভেঙে পড়া দুটি পরিবার, কিন্তু মাথা নিচু নয়

নূরের পরিবার কিংবা সোহাগের পরিবার— কেউই আর ঢাকায় ফেরেনি। গ্রামেই রয়ে গেছে স্মৃতির ভার নিয়ে। বাবারা কৃষিকাজ আর রিকশা চালিয়ে বেঁচে থাকেন, মায়েরা ছেলেদের শেষ কথাগুলো বুকের গহীনে ধরে রাখেন। বড় বোনেরা এখনো হঠাৎ ঘুম ভেঙে বলে ওঠেন, ‘নূর!’ কিংবা ‘সোহাগ!’

সোহাগের বড় ভাই সোহেল, যিনি নিজেও রাজনৈতিক প্রতারণার শিকার হয়ে স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যৎ কেড়ে নেওয়া হয়েছে আমাদের কাছ থেকে। আমাদের কণ্ঠ বন্ধ করতে পারেনি, মন ভাঙতে পারেনি।’

নূর আর সোহাগ— তারা আজ হয়ে উঠেছে এক প্রজন্মের প্রতীক, যারা বৈষম্য আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বুক চিতিয়ে। কেউ কোরআন মুখস্থ করতে চেয়েছিল, কেউ বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা পেরেছিল সত্যের জন্য শহীদ হতে। 

আলো আর অন্ধকারের লড়াইয়ে এই কিশোরদের মৃত্যু যেন বলে—‘তাদের শরীর গিয়েছে, কিন্তু স্বপ্ন থেকে গেছে জীবিতদের চোখে-মুখে।’

সূত্র: বাসস

এমআই/এএইচ