মো. মেহেদী হাসান হাসিব
২৪ মে ২০২৫, ০৭:৩১ পিএম
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনের নামে জন্মসাল পরিবর্তনের প্রবণতা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনে জমা পড়া কিছু আবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এমন কিছু নাগরিক রয়েছেন যারা নিজের জন্মসাল এমনভাবে পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন, যাতে তারা ভোটার হওয়ার সময় কার্যত শিশু বয়সে ছিলেন যা আইনত অসম্ভব এবং বাস্তবতাবিরুদ্ধ। এমন সব আবেদন ঘিরে সম্প্রতি ইসির কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র বিতর্ক।
ভোটার ছিলেন কিশোর, এখন দাবি করেন শিশু!
নিজাম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি, যিনি ২০০৭ সালে ভোটার হয়েছেন, বর্তমানে তার এনআইডিতে জন্মসাল রয়েছে ১৯৮৬। কিন্তু তিনি ১৭ বছর পর, ২০১৮ সালের জন্মসনদ ও ২০২৩ সালের পাসপোর্ট দেখিয়ে জন্মসাল ২০০১ চেয়ে সংশোধনের আবেদন করেছেন। যদি এটি অনুমোদন হয়, তবে ভোটার হওয়ার সময় তার বয়স দাঁড়াবে মাত্র ৬ বছর।
আজহারুল ইসলাম মাহবুব, যার বর্তমান জন্মসাল ১৯৮৯ এবং ভোটার হয়েছেন ২০০৭ সালে, তিনি ২০২১ সালের জন্মসনদ দিয়ে জন্মসাল ২০০৫ দাবি করছেন। এতে তার ভোটার হওয়ার সময় বয়স হবে মাত্র ২ বছর যা সংবিধান ও বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মো. মঈন উদ্দিন নামের ভোটারের এর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা তার বর্তমান জন্মসাল ১৯৮৪, কিন্তু তিনি ২০২৪ সালের দাখিল পাশের সনদ দেখিয়ে জন্মসাল ২০০৪ দাবি করছেন। যদি তা অনুমোদিত হয়, তবে ২০০৭ সালে ভোটার হওয়ার সময় তার বয়স হবে ৩ বছর মাত্র।
ভোটার হওয়ার আগেই মাধ্যমিক পাস! তথ্য জালিয়াতির স্পষ্ট আলামত
গৌছ উদ্দিন নামে আরেক ব্যক্তি, যিনি ২০০৯ সালে ভোটার হন এবং এনআইডিতে জন্মসাল ১৯৯১, তিনি জন্মসাল সংশোধন করে ২০০৮ দাবি করেছেন। অথচ তার ভোটার হওয়ার সময় তিনি মাধ্যমিক পাশ করে ভোটার হয়েছে। এতে ১৪ বছর পর এসে ২০১৭ সালের কারিগরি বোর্ডের মাধ্যমিক পাশের শিক্ষাসনদ দিয়ে ২০০৮ জন্মসাল চাওয়াতে ভোটার হওয়ার সময় তার বয়স হয় ১ বছর যা চরম অসঙ্গতি এবং স্পষ্ট প্রতারণার ইঙ্গিত বহন করে।
এমন আরও প্রায় ৫০টি আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোনো নাগরিক এসেছেন একবার বয়স সংশোধনের পর আবার নতুন একটি জন্মসনদ তৈরি করে আবার বয়স সংশোধনের আবেদন নিয়ে। আবার কেউ কেউ ডাটাবেজে শিক্ষা সনদ থাকার পরও শিক্ষাগত যোগ্যতা কমিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী আবেদন করছেন যা অযৌক্তিক আবেদন ও নৈতিকভাবেও ঠিক নয় বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ইসি কর্মকর্তা জানান, বর্তমান সময়ে এমন আবেদনের সংখ্যা অনেক বেশি। যারা এমন আবেদন করেন তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। তাদের আবেদনের ভিড়ে যেসকল নাগরিকের সত্য সংশোধনের প্রয়োজন তারা পিছিয়ে পড়ছেন। এতে আমাদের যেমন বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়; তেমনি নাগরিকদের সেবা পেতে দেরি হয়। কারণ এসব অযৌক্তিক আবেদন নিষ্পত্তিতে অনেক সময় চলে যায়।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, এসব অযৌক্তিক এনআইডি সংশোধন আবেদন এনআইডি তথ্যভাণ্ডারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। এই প্রবণতা মূলত নতুন করে বয়স কমিয়ে চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা বিদেশযাত্রার সুবিধা নেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে। তবে যারা প্রবাসে অবস্থান করছে কিংবা দীর্ঘদিন থেকে চাকরি করছে তাদের ক্ষেত্রে আমরা নমনীয়। তাদের আবেদনগুলো আমরা সহজ বিবেচনা করি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, বেশিরভাগ আবেদনেই সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি করা জন্মসনদ ও শিক্ষাগত সনদ দাখিল করা হয়। অথচ পূর্বের সরকারি রেকর্ড, ভোটার তালিকা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা এসবের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
নাগরিকদের অযৌক্তিক এনআইডি সংশোধনের আবেদনগুলোর বিষয়ে ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহপরিচালক এ এস এম হুমায়ূন কবীর ঢাকামেইলকে বলেন, আমার কাছে কোনো আবেদনই অযৌক্তিক না। যখন কোনো নাগরিক আমার কাছে আবেদন করে তখন ওই আবেদনটা বিবেচনা করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তবে কিছু কিছু নাগরিক আছেন যারা অকারণেও সংশোধনের আবেদন করে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু নিয়ম-কানুন করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এনআইডি তথ্য সংশোধনের পদ্ধতিকে জবাবদিহিতামূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর না করলে এই ধরনের তথ্য বিকৃতি আরও বাড়বে।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী, তথ্য-উপাত্তের সংশোধনের প্রয়োজন হলে নাগরিক কর্তৃক প্রদত্ত আবেদনের ভিত্তিতে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে ও ফি প্রদান সাপেক্ষে, নিবন্ধক কর্তৃক সেটা সংশোধন করা যাবে। অথবা উক্ত তথ্য-উপাত্ত জাতীয় পরিচয়পত্রে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ না হলে নাগরিক কর্তৃক প্রদত্ত আবেদনের ভিত্তিতে নিবন্ধক কর্তৃক, কোনো প্রকার ফি প্রদান ব্যতিরেকে, তা সংশোধন করা যাবে।
এই আইনের ১৮ ধারা অনুযায়ী, কোনো নাগরিক জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির লক্ষ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপন করলে তাকে ১ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সবশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ২৭৪ জন।
এমএইচএইচ/এফএ