images

জাতীয়

স্বপ্ন বোনার দায়, কিন্তু ন্যায্যতার ছেঁড়া চাদর!

মাহাবুল ইসলাম

০১ মে ২০২৫, ০৯:৩০ পিএম

কারখানা, কৃষি, নির্মাণ, পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে বাসাবাড়ি সবক্ষেত্রেই প্রতিদিন ঘাম ঝরিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরাচ্ছেন শ্রমিকরা। শ্রমিকরা স্বপ্ন বুনছেন- দেশ গড়ার, ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের। কিন্তু যে ঘামে রচিত হচ্ছে এই উন্নয়ন, সেই ঘামই ন্যায্য প্রতিদানহীন। শ্রমিকের জীবন যেন এক ছেঁড়া চাদরের মতোই— যেখানে বঞ্চনার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে অনিশ্চয়তা, অবহেলা আর অবমূল্যায়ন। তাদের জীবনে নেই ন্যায্য মজুরি, শ্রম-সুরক্ষা বা স্থায়ী নিরাপত্তার নিশ্চয়তাটুকুও।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএসের) তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৮৫ ভাগ শ্রমজীবী মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। যাদের দিন খাটলে পেট চলে। আবার কৃষি শ্রমিকরা মৌসুমি চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। যাদের আয় অপ্রতুল ও অনিয়মিত। সেখানে যদি আবার আদিবাসী হয়; তাহলে বৈষম্যের চিত্র আরও ভয়াবহ। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আদিবাসী নারী-পুরুষ কাজ করেন। অথচ মজুরি পুরুষ পান ৫০০ আর নারী ৩০০। পোশাক খাতে কাজ করা নারী শ্রমিকরাও প্রায়শই হয়রানি ও নিম্ন মজুরির শিকার হন। বাসাবাড়ির গৃহকর্মীরা এখনো শ্রম আইনের আওতার বাইরে। বিশাল সংখ্যক পরিবহন শ্রমিকও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থেকেও সামাজিক সুরক্ষা পান না। অমানবিক বৈষম্যের শিকলে বাঁধা শিশু শ্রমিকরাও। যা থেকে উত্তরণ চান বলছেন মালিক,  শ্রমিক এবং সরকারও। তাহলে শুভঙ্করের ফাঁকিটা কোথায়? কোথায় আটকে যায় শ্রমিকের নায্য অধিকার।

কৃষিশ্রমিক: জমিতে রক্ত-ঘাম, ঘরে দরিদ্রতার হাহাকার

বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশের ৪২.৭১ শতাংশ কর্মসংস্থান আসে কৃষিখাত থেকে। অথচ এ খাতের শ্রমিকদের আয় সবচেয়ে অনিয়মিত। অনেকে আবার মৌসুমি শ্রমিক। ফসলের সময় বাদে কর্মহীনতাও দেখা দেয়। এরমধ্যে রয়েছে মজুরিতে নারী-পুরুষ ও আদিবাসী বৈষম্য। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবেও তাদের জীবিকা আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলে এই সংকট আরও বেশি।

উত্তরাঞ্চলে পানির সংকট সরাসরি শ্রমিকদের জীবনযাপনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। গোদাগাড়ীর আদিবাসী নারী মমতা টপ্প্য ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা সারাবছরই থাকে। স্বামী-স্ত্রী কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই মানুষের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করি। একইতালে কাজ করার পরেও দেখা যায় মজুরি আমার ৩০০ এবং ছেলেদের ৫০০ টাকা। আবার যারা আদিবাসী না তাদের মজুরি ৭০০ টাকা পর্যন্ত।

আদিবাসী শ্রমিক নেতা সরল এক্কা ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা রক্ত-শ্রম দিয়ে ফসল উৎপাদন করছি। কিন্তু আমরা প্রতিদানে কেন ন্যায্য অধিকারটুকু পাচ্ছি না।

ওই অঞ্চলে আদিবাসীদের মানবাধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে কাজ করেন মো. নিরাবুল ইসলাম। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, এখানে মালিক-শ্রমিকের সর্ম্পক অনেক সুন্দর। কিন্তু মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে পুরোনো রীতির কষাঘাত এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ছাড়া এটা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না।

পোশাক খাত: বৃহৎ আয়, ক্ষুদ্র ভাগ

বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্প। দেশে ৫০ লক্ষাধিক শ্রমিক এ খাতে কর্মরত। যার ৬২ শতাংশই নারী। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্য উৎপাদন করা এসব শ্রমিক মাসে পান গড়ে ১২-১৪ হাজার টাকা বেতন। আবার না চাইলেও বাধ্যতামূলক ওভারটাইম কাজ করতে হয়। নেই তেমন কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আবার প্রতিষ্ঠান ছোট হলে নিয়মিত বেতন পাওয়াও দুষ্কর।

দেশের একটি প্রথম সারির কোম্পানিতে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারী বলেন, প্রতিষ্ঠানে বেতন শুধু কমই না। যে পরিমাণ শ্রম আমরা প্রতিষ্ঠানকে দেই, তার বিনিময়ে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটুকু। অনেক সময় কাজের চাপে দুপুরে খেয়েছি কি না? সেটিও ভুলে যাই। কিন্তু মাস শেষে মালিকের যে আচরণ প্রকাশ পায়, তা কখনোই কাম্য নয়।

গার্মেন্টস শ্রমিক নজরুল ইসলাম বলেন, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের বেশকিছু দাবি এখন মেনে নিয়ে কাজ করাচ্ছে। কিন্তু দেশের তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো নূন্যতম বেতনটুকুও দিচ্ছে না। আমরা শ্রমিকরা দেশ গড়তে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে দিচ্ছি। আমাদের ন্যূনতম অধিকারটুকু তো কামনা করতেই পারি।

নির্মাণ ও ইলেকট্রিক খাত: মৃত্যুর ঝুঁকিতে প্রতিদিন

রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি শহরে-বন্দরে চলছে নির্মাণ কাজ। চলছে সরকারের বড় বড় নির্মাণ প্রকল্পও। কিন্তু নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। আবার প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ইলেকট্রিক খাতের ঝুঁকিপুর্ণ কাজে নিয়োজিত কর্মীদেরও নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এতে প্রায়শই ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনা। এ নিয়ে মালিক পক্ষসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর উদাসীনতাও স্পষ্ট।
শফিকুল ইসলাম নামের এক শ্রমিক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের যে কাজ তা ঝুঁকিপূর্ণ। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মালিক নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে রাজি হয় না। আর আমরা তো মজুরি ভিত্তিতে কাজ করি। সংশ্লিষ্ট দফতর ও প্রশাসনিক তৎপরতা থাকলে মালিক বাধ্য হতো আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে কাজ করাতে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মালিকের অবহেলায় শ্রমিকের মৃত্যুর মতো ঘটনাতেও বিচার হচ্ছে না।

গৃহকর্ম: বঞ্চনার নীরব চক্র

গৃহকর্মীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাজ করেন। সকাল থেকে শুরু করে রাত অবধি। কোনো ছুটি নেই, নেই লিখিত চুক্তি। যৌন হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন এগুলো গৃহকর্মীদের জন্য নিত্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে ‍তারকা থেকে শুরু করে মুখোশধারী সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও রয়েছেন।

ঢাকায় সিনেমার এক নায়িকার বাসায় কাজ করতেন পিংকি আক্তার। তিনি বলেন, তারকা দেখে বাইরের মানুষ ভাবে মালিক অনেক ভালো। কিন্তু আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবেও নির্যাতন করা হয়েছে। প্রতিবাদ করায় চাকুরি থেকেও বাদ দিয়েছে। শেষ মাসের বেতনটুকুও পাইনি।

Info

পরিবহন খাত: চাকা ঘুরে, অধিকার থাকে থমকে

রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে বাস থেকে শুরু করে ট্রাক ও অন্যান্য পরিবহন খাতেও মালিকদের নৈরাজ্যের চিত্র স্পষ্ট। এখানে কর্মরত চালকসহ অন্য কর্মীদেরও দীর্ঘ সময় কাজ করানো হয়। অথচ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। দুর্ঘটনা হলে চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক সময় বহন করে না মালিক। মালিকপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাও অধিকাংশ সময় দায় এড়িয়ে যায়।

পরিবহন শ্রমিক মানিক হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি হেলপার অবস্থায় দুর্ঘটনায় আমার একটি পা ভেঙে যায়। পরে জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছি। মালিক যা সহায়তা করেছে, তা নামমাত্র। এখন ভাঙা পা নিয়েই গাড়ি চালাই। কিন্তু আমার যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা আমার অধিকার, সেটি কি আছে?

হোটেল-রেস্তোরা ও সেবাখাত: অনিশ্চয়তা ও অবমূল্যায়ন

হোটেল, ফাস্টফুড, সেলুন কিংবা ডেলিভারি খাতের শ্রমিকরা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন। যেকোনো দিন চাকরি হারানোর ভয়। নেই সামাজিক সুরক্ষা, নেই অবসর সুবিধাটুকুও।

একটি রেস্তোরায় কর্মরত সুজন আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, ভাই জীবিকার তাগিদে কাজ করছি। মালিকের তৈরি করা নিয়মে চলতে হয়। মালিক শ্রম আইনকে কোনো পাত্তাই দেয় না। যেদিন শ্রম আইনের কথা বলব, তার পরের দিন থেকে দেখা যাবে কাজে আসতেই নিষেধ করে দেবে।

আজ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বিশ্বজুড়ে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দিন। বাংলাদেশে সরকারি ছুটি থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশ শ্রমিকই আজও কর্মক্ষেত্রে। তাদের জীবনে নেই ছুটি, নেই বিশ্রাম, নেই নিরাপত্তা। তবুও দেশ গড়তে স্বপ্ন বোনার দায় কাঁধে। কিন্তু ন্যায্যতার চাদর তো ছেঁড়া! সে চাঁদর জড়িয়ে দিন বদলের স্বপ্নে বিভোর দেশের প্রায় ৭ কোটি ৬ লাখ শ্রমজীবী মানুষ।

এমআই/এফএ