ঢাকা মেইল ডেস্ক
১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩০ পিএম
ব্যস্ত ও জ্যামের শহর রাজধানী ঢাকা। এই নগরীতে দ্রুতগতির বাহনও চলে কচ্ছপ গতিতে। এই অস্বস্তির মাঝে স্বস্তির বার্তা এনে দিয়েছে মেট্রোরেল সেবা। দিন দিন এই গণপরিবহনের চাহিদা শুধু বাড়ছেই। তবে একটি মাত্র রুটে চালু হওয়া মেট্রোরেল এই মেগা সিটির বাসিন্দাদের চাহিদা মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। ধারণক্ষমতার তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় মেট্রোরেলে যাতায়াতে বাড়ছে বিড়ম্বনাও।
বিশেষ করে চলতি রমজান মাসে অফিস ছুটির পর একসঙ্গে হাজার হাজার মেট্রোরেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ায় অস্বস্তিও বাড়ছে। তবু যানজটের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি এবং সময় সাশ্রয় হওয়ায় মেট্রোরেলই ভরসা নগরবাসীর।
রাজধানীর মিরপুর এলাকায় একটি হাসপাতালে কাজ করেন শামীম আহম্মেদ। মাঝে-মধ্যেই তাকে শাহবাগ এলাকায় আসতে হয় অফিসের প্রয়োজনে। বাসে উঠলে গন্তব্যে পৌঁছাতে ও আবার ফিরে যেতে তার সময় লেগে যায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। যানজটের কবলে পড়লে এ সময় আরও দীর্ঘায়িত হয়। তার ভাষ্যমতে, মেট্রোরেল সেবার সবচেয়ে বড় ও মুখ্য স্বস্তির জায়গাটা হলো- সময়। এখানে গাড়ি নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়বে, নির্দিষ্ট সময়ে থামবে। একারণে বাকি যে দুর্ভোগগুলো আছে, তা নিয়ে ভাবেন না তিনি।
মেট্রোরেল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) তথ্য বলছে, ছয়টি কোচ সংবলিত প্রতিটি একমুখী মেট্রোরেল প্রতিবারে মাত্র ৩৮ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬ স্টেশনে যাত্রী পরিবহন করছে। সময়ের কড়া নজরদারির পাশাপাশি মেট্রোরেল রাজধানীতে যে আধুনিক সেবা দিচ্ছে তা অন্য গণপরিবহনগুলো দিতে পারে না। আধুনিক প্রযুক্তির একটি সুন্দর প্যাকেজ প্রোগ্রাম পাচ্ছেন যাত্রীরা। এখানে নারী, শিশু এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থাও রয়েছে। এখানে যাত্রীরা লিফট, সার্বক্ষণিক এসি, টয়লেট সুবিধাসহ প্রাথমিক চিকিৎসার মতো সেবাগুলোও পাচ্ছেন। রাজধানীর অভ্যন্তরীণ রুটে অন্য কোনো পরিবহনে এই সেবা নেই।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, চলতি রমজানে তারা সেবার সময়সূচিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন। প্রতিটি ট্রেন এখন ৮ থেকে ১০ মিনিট সময়ের ব্যবধানে চলানো হচ্ছে। এছাড়া মেট্রোরেলে ইফতারে পানি পান করার জন্য মেট্রোরেল ও স্টেশন এলাকায় ২৫০ মিলি লিটার পানি বহনের অনুমতিও দিয়েছেন।
রাজধানীর মতিঝিলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারী রুবাইয়া সুলতানা ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করি। আমার স্বামী বাড্ডায় একটি প্রতিষ্ঠানে আছেন। আমি মতিঝিলে। আমরা থাকি মিরপুর-১১ নম্বরে। দীর্ঘ সময় ধরে আছি, তাই বাসাও পরিবর্তন করিনি। আমরা দুজনেই অফিস থেকে একই সময়ে বের হই। কিন্তু বাসায় আমি সবসময় ওর আধাঘণ্টা কখনো এক-দেড় ঘণ্টা আগে পৌঁছাতে পারি। যেটা মেট্রোরেলের সুবাদেই সম্ভব হয়েছে। এছাড়া রমজান মাসে বাসায় গিয়ে ইফতারির সুযোগটাও পাই। সেটা আগে গাড়িতেই করতে হতো।
আছে কিছু অস্বস্তি ও উদ্বেগও
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে তৈরি করা মেট্রোরেলে যাত্রীদের জন্য নানা সুবিধা এনে দিলেও অসুবিধা ও উদ্বেগ ছড়ানোর মতো বিষয়গুলোও কম নয়। যা অনেক যাত্রীই মেট্রোরেলে যাতায়াতের ‘ঝুঁকি ও ক্ষতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে এই সেবাকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে অধিকাংশ মানুষই এই ঝুঁকিটিকে মাথায় রেখে সতর্কতার সঙ্গেই মেট্রোরেলের যাতায়াত করছেন।
ডিএমটিসিএলের তথ্যমতে, মেট্রোরেলের প্রতিটি ট্রেনে ছয়টি কোচ রয়েছে। এর মধ্যে দুই প্রান্তের দুইটি কোচকে বলা হয় ট্রেইলর কার। এতে থাকেন চালক। এসব কোচে ৪৮ জন করে যাত্রী বসতে পারেন। মাঝখানের চারটি কোচ হচ্ছে মোটরকার। সেখানে বসতে পারবেন ৫৪ জন। সব মিলিয়ে একটি ট্রেনে বসে যেতে পারেন ৩০৬ জন। সাড়ে নয় ফুট চওড়া কোচগুলোর মাঝে দাঁড়িয়েও যাত্রীরা ভ্রমণ করতে পারেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, আসন ৩০৬ জনের হলেও মেট্রোরেলে অধিকাংশ সময়ই তিল পরিমাণ ঠাঁই থাকে না। যাত্রীরা একে অন্যের গায়ে গা লাগিয়ে ধাক্কাধাক্কি করেই মেট্রোরেলে যাতায়াত করছেন। নারীদের জন্য একটি বিশেষ কোচ থাকলেও সেটা অপর্যাপ্ত হওয়ায় অন্য কোচেও নারী উঠছেন। কোচগুলোতে যাত্রীদের চাপ এতটাই বেশি যে, একবার উঠে গেলে নড়াচড়ার সুযোগও অধিকাংশ সময় থাকছে না। অনেক সময় ভিড়ের কারণে প্রাণ যায় যায় অবস্থা হয়ে যায়। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরা। প্রায়ই যাত্রীদের বাকবিতণ্ডায় জড়াতে দেখা যাচ্ছে। রয়েছে চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগও। এছাড়া নিম্ন-মধ্যবিত্তের অনেকেই বাড়তি ভাড়ার কারণে মেট্রোসেবাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
গর্ভবতী নারী ও বয়স্ক নারী যাত্রীদের জন্য মেট্রোরেলের কোচের ভেতরে সংরক্ষিত আসন রাখা হয়েছে। আলাদা আসন থাকছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যও। কিন্তু যাত্রীদের অত্যধিক চাপের কারণে এসব বিশেষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন পারভেজ রনি। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শুধু যানজট সমস্যার কারণে অফিস যাতায়াতে আমি মেট্রোরেল সেবা নিয়ে থাকি। এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মেট্রোরেলের মধ্যে তিল পরিমাণ ঠাঁই থাকে না। যতক্ষণ গাড়িতে থাকি, ধাক্কাধাক্কি করেই যেতে হয়। এছাড়া পরিবহন খরচও এখানে দ্বিগুণ। শুধু সময়ের কারণে মেট্রোরেল সেবা নিই।’
বাংলামোটরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আকাশ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মেট্রোরেলে অসুস্থ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকলেও সে সেবাটা তারা নিতে পারেন বলে মনে হয় না। আমি আমার অসুস্থ মাকে ডাক্তার দেখিয়ে মেট্রোতে করে বাসায় ফিরছিলাম। ট্রেন থেকে নেমে দেখি, মায়ের গলায় স্বর্ণের চেইনটা নেই। স্টেশনের লোকদের জানিয়েও লাভ হয়নি। এত ভিড়ের মধ্যে কে নিয়েছে, কীভাবে সেটা বোঝা সম্ভব!’
আফসানা আফরোজ নামের এক কলেজ ছাত্রী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বেশি ভাড়ার কারণে সাধারণ মেট্রোকে এড়িয়ে চলি। কিন্তু যখন দেখি হাতে সময় বেশি নেই তখন মেট্রোরেল সেবা নিতে হয়। কিন্তু এখানে এত ভিড় যে, ছেলে-মেয়ে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সবাই চারদিক থেকে চেপে ধরে। এটা খুবই বিব্রতকর নারীদের জন্য। আবার মাঝেমধ্যে যেভাবে ধাক্কা দেয়, যে কারও ইনজুরি হতে পারে। এছাড়া মাঝেমধ্যে লম্বা সিরিয়ালও পড়ে।’
এদিকে, মেট্রোরেল সেবা কতটা সার্বজনীন রূপ পাচ্ছে, তা জানতে মেট্রোরেলসেবা গ্রহণ করেন না এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। এসময় তারা জানান, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্তের অনেকেই কষ্টে আছেন। তাদের ইচ্ছে থাকলেও তারা মেট্রোরেল সেবা নিতে পারছেন না।
এমনই একজন আসমা খাতুন। তিনি শাহবাগে একটি হাসপাতালে কাজ করেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি মাসে ১৬ হাজার টাকা আয় করি। সেটিও নিয়মিত না। আমার আয়ে পাঁচজন সদস্যের সংসার চলে। ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া দিয়ে এই আয়ে জীবন স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যাওয়া কঠিন। একারণেই পাবলিক বাস ব্যবহার করি। মেট্রোতে অনেক ভাড়া। একারণে এক দুইবার জরুরি প্রয়োজনে উঠেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি স্টেশনের কন্ট্রোলার জানান, মেট্রোরেলে সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। উপচেপড়া ভিড় না থাকলে মেট্রোরেল লোকসান এড়াতে পারবে না। এত এত মানুষ যাচ্ছে বলেই মেট্রোরেল সেবা টিকে আছে।
মেট্রোরেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মেজর মোহাম্মদ জাকির সিদ্দিকী (এলপিআর) ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যার ভালো আছে, তার কিছু খারাপ থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে আমি চাইলেই কথা বলতে পারি না। এক্ষেত্রে অফিসিয়াল কিছু নিয়ম আছে। আমাকে অনুমতি নিয়ে কথা বলতে হবে। আপনি অফিসে আসেন।’
এমআই/জেবি