মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
১৭ মার্চ ২০২৫, ০২:১২ পিএম
রাজধানীর কর্মজীবী মানুষ ঘর থেকে বের হয়েই প্রথম যে দুর্ভোগের মুখোমুখি হয় তা হচ্ছে ধুলা দূষণ। প্রায় সারা বছরই নগরজুড়ে লেগে থাকে খোঁড়াখুঁড়ি। আর এর কারণে ঢাকা শহর পরিণত হয়েছে ধুলার নগরে। অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে ধুলা দূষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কোনো এলাকার মানুষই। শুধু রাজধানী ঢাকাই নয়, আশপাশের জেলাগুলোতেও যানবাহন, ইটভাটা ও কলকারখানার কারণে হচ্ছে বায়ুদূষণ। সাধারণত দেশে অক্টোবর থেকে মার্চের শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণের মাত্রা ব্যাপকভাবে বাড়ে৷ ঢাকায় তখন পরিস্থিতি হয়ে উঠে ভয়াবহ।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ এলাকার সড়কেই চলছে কোনো না কোনো কাজের খোঁড়াখুঁড়ি। পাড়া মহল্লার সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা। এরমধ্যে রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট হয়ে যাত্রাবাড়ী সড়কে এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় এই সড়কে যেন ভোগান্তির শেষ নেই। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী- বিমানবন্দর সড়কের নতুন বাজার, কুড়িল সড়কেও চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। কমলাপুর, মতিঝিল, পুরান ঢাকার বেশির ভাগ সড়কেই প্রকট ধুলা দূষণ। এছাড়াও তেজগাঁও, সাতরাস্তা, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, ইন্দিরা রোডসহ বিভিন্ন সড়কে খানাখন্দের কারণে যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। মোহাম্মদপুরের কিছু সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে, যা এলাকাবাসীর চলাচলে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। দক্ষিণখানের কসাইবাড়ি থেকে দক্ষিণখান বাজার পর্যন্ত সড়কে দীর্ঘদিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, যেটা নগরবাসীর চরম দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। বিভিন্ন সড়কে কী পরিমাণ ধুলা দূষণ তা সড়কের আইল্যান্ডে লাগানো গাছের পাতার ধুলার স্তর দেখেই অনুমান করা যায়।
দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজের সামনের সড়কটির বেহাল অবস্থা। এই সড়কে যারা চলাচল করেন তাদের মাস্ক ছাড়া বের হওয়ার উপায় নেই। এই সড়ক দিয়ে মানুষ চলাচল করার সময় পাশ দিয়ে গাড়ি গেলে পুরো ধুলাবালি এসে পড়ে মানুষের শরীরে। মুগদা এলাকার বাসিন্দা শাহিনুর বলেন, ‘অনেক দিন ধইরাই এই রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। ধুলায় রাস্তা দিয়ে চলাচল করা যায় না। এই রস্তা দিয়ে একবার গেলে অবস্থা খারাপ হইয়া যায়। কারো কোনো মাথাব্যথা নাই।’
এই সড়কে চলাচলকারী শরিফ বলেন, ‘আমি মুখে মাস্ক রাখতে পারি না। মাস্ক পরলে কেমন যেন দম বন্ধ লাগে। কিন্তু এই রোডে যে ধুলা তাতে মাস্ক না পইরা কোনো উপায় থাকে না। এই রাস্তা দিয়ে একবার গেলে ধুলায় কাপচোপর যেন নষ্ট হইয়া যায়।’
রাজধানীর ভাটারার ষাট ফিট সড়ক যেন ধুলার স্বর্গরাজ্য। এই সড়কে একটি গাড়ি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই ধুলার স্তর পড়ে যায়। এই সড়কে নিয়মিত চলাচলকারী এক রিকশাচালক বলেন, 'অনেক দিন ধরে রাস্তাটির এই অবস্থা। মাস্ক পইরা থাকলে নাকে মুখে ধুলা ঢুকে। ধুলার কারণে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। কবে এই রাস্তা ঠিক হবে তা কে জানে।'
সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার ‘বৈশ্বিক বায়ু মান প্রতিবেদন ২০২৪’ তুলে ধরেছে। সেখানে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ২০২৪ সালের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ।
বাতাসের গুণমান সূচক (একিউআই) দিয়ে দূষণের মাত্রা নির্ধারণ করে নিয়মিত বায়ু পরিস্থিতি তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ-এয়ার। তাদের তালিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই দূষণের প্রধান উৎস। বেশি মাত্রার দূষণ শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদ্রোগ এবং দীর্ঘ মেয়াদে ক্যানসারের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, বায়ুমান সূচক ৫০-এর নিচে থাকলে বিশুদ্ধ বাতাস ধরা হয়। ৫১-১০০ হলে তা সহনীয়। ১০১-১৫০ এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১-২০০ হলে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে বাতাসকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর সূচক ৩০০ ছাড়ালে সেই বাতাস দুর্যোগপূর্ণ।
বায়ু দূষণের মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১০৭ মাসের তথ্য প্রতিদিন প্রকাশ করেছে৷ ২০২৪ সালে শুধু ঢাকাতেই ৬ দিন ছিল ‘চরম ঝুঁকিপূর্ণ', ৯৩ দিন ছিল ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর', ৭০ দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর', ১৩৩ দিন ছিল ‘সতর্কতামূলক' এবং ৪৯ দিন ছিল ‘মাঝারি মানের' বায়ু৷ তাদের হিসেব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মাত্র ১১ দিন ঢাকায় বাতাসের মান ‘ভালো' ছিল৷ বছরের বাকি ৪ দিনের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান পাঁচটি কারণের মধ্যে দ্বিতীয়৷ এবং বাংলাদেশেই মৃত্যুর শীর্ষ ১০টি কারণের মধ্যে চারটি সরাসরি বায়ু দূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত: স্ট্রোক, নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ ও ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ৷ সম্প্রতি, সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরই) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যে্ সূক্ষ্মকণা বায়ুদূষণের প্রভাব' শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বায়ুমান বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুর মানদণ্ড অর্জন করতে পারলে বাঁচানো সম্ভব হতো ৮১ হাজারের বেশি প্রাণ।
পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্বব্যাংক ঢাকার বায়ুদূষণের ওপর এক গবেষণার তথ্য বলছে, তিন কারণে ঢাকায় বায়ুদূষণ বেশি। তা হলো- যানবাহনের ধোঁয়া ও ধুলা, কাজের সৃষ্ট ধুলা, ইটভাটার ধোঁয়া। রাজউকের তথ্যানুসারে বছরে ৫০০টি নতুন ভবন তৈরি হয়। নতুন ভবন নির্মাণ তাদের অনেকেই ধুলার উৎস প্রতিরোধ না করে ভবনসমূহ নির্মাণ করেন। শীতের সময় প্রতি বছরই ঢাকার সড়কে বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি চলে। এগুলো থেকে প্রচুর ধুলা তৈরি হয়। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ফুটপাত ও নর্দমা সংস্কারের জন্য প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের বেশি সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলে। এসব সড়ক উন্নয়নের কাজ ঠিকাদাররা ধুলা নিয়ন্ত্রণ করে করার কথা থাকলেও তারা তা করছেন না বা মানছেন না। সরকার নির্মাণ কাজে ইটের বদলে ব্লক এবং সিমেন্টের বদলে স্প্যাশাল গাম ব্যবহারের নির্দেশ দিলেও কার্য্যত সেখান থেকে কোনো সুফল আসেনি।
এ বিষয়ে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে বায়ু দূষণ ত্রিমাত্রিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটার কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। বরং প্রতি বছরই বাড়ছে। এর যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তা এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। দেড় যুগ ধরে অতিরিক্ত দূষণের কারণে এখন স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই অনেক পরামর্শ দিয়ে আসছি। তার মধ্যে রাস্তায় মাঝেমধ্যে কিছু পানি ছিটাতে দেখা যায়, আর সম্প্রতি কয়েকশ ইটের ভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব সামান্য। কিন্তু এখনও আরও অনেক করণীয় বাকি আছে।
টিএই/জেবি